আজ কবিতা দিবস। এই দিবসে কবিতার একটি নতুন বই নিয়ে আলোচনা করতে চাই। বইটির নাম ‘অস্পর্শিয়া’। বইটির রচয়িতা কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক ও শিক্ষক রনজু রাইম। এটি তার সতেরোতম বই। বইটিকে বলা হচ্ছে প্রেমের সনেট। বইটি সম্পর্কে কবি বলেছেন, ‘অস্পর্শিয়া একবই প্রেমের সনেট। সনেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ। আমি একে অনুসনেট বলি। অক্ষরবৃত্তে মাত্রা, পর্ব ও পঙক্তি বিন্যাসে স্বাধীনতা আছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এরকম কিছু অনুসনেট লিখে নিরীক্ষা করেছিলাম। আমার ‘চিত্রল প্রতিবেদন’ কাব্যগ্রন্থে এরকম দু-চারটি অনুসনেট মুদ্রিত হয়েছে। ‘অস্পর্শিয়া’ অভিন্ন শিরোনামে সে-রকম অনুসনেট।’
Advertisement
বইটিতে ‘অস্পর্শিয়া’ শিরোনামে চল্লিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতার আঙ্গিক-প্রকরণ নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে কবিতার শিল্পরূপ বা কবির দর্শন সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলতে চাচ্ছি। কেননা ছন্দবিমুখ একটি সময়ে এমন একটি অনুসনেট ছন্দের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। সমকালীন ছন্দবিরোধী কবিদের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। ছন্দ ছাড়া কবিতা যেমন কবিতার মোড়কে গদ্যের মতো। আমার মতে, কবিতা যদি বলতেই হয়—তাহলে ছন্দ, মাত্রা, পর্ব মেনেই হোক। না হলে কবিতা তার পরিচয় থেকে বিলীন হয়ে যাবে। গদ্য বলার আলাদা ধরন তো রয়েছেই সাহিত্যে।
বইটিকে বলাই হয়েছে প্রেমের সনেট। সুতরাং এতে প্রেম খুঁজে পাওয়া অনেকটাই সহজ। সেই প্রেম অভিসারে, তপোবনে কিংবা আড়ালে ছুঁয়ে দেখার মতোই। এই প্রেম স্পর্শহীন সুখ কিংবা বিলাসী অসুখ। এ প্রেম হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যায়। এই প্রেম মগ্ন হয় কবিতায়। তাই তো কবি বলেছেন—‘অভিসারে যাওয়ার মতো নেই কোন তপোবনতোমাকে লুকিয়ে দেখবার মতো আড়ালও নেইউন্মাদ নগরে এ হৃদয় খুঁজে শুধু তোমাকেইকবিতায় করবো আড়াল তারপর ছুঁবো মন।’(অস্পর্শিয়া-১, পৃষ্ঠা-৯)
কবির ‘অস্পর্শিয়া’ যেন সব ধর্মের ঊর্ধ্বে। কবি তাকে কখনো কল্পনা করেন দেবী রূপে। আবার কল্পনা করেন জায়নামাজের সিজদায়। ফলে তার প্রেম অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রোজ্জল বার্তা বয়ে আনার চেষ্টা করে। কবির ভাষায় বলতে হয়—১.অস্পর্শিয়া, সত্যি বল তুমি কোন দেবলোকে থাকমাটির প্রতিমা গড়ে তোমাকেই পুজো দেব রোজ(অস্পর্শিয়া-৩, পৃ-১১)২. অস্পর্শিয়া, প্রার্থনার জায়নামাজে সিজদা তুমিকাবায় আনত প্রেম মরীচিকা মরুর কুসুম(অস্পর্শিয়া-৫, পৃ-১৩)
Advertisement
কবির দৃষ্টিতে কবিতা আসলে কী? তা জানা যায় তার কবিতার মাধ্যমেই। কবিতা কারো কাছে প্রেমের বাণী। কবিতা কারো মনের অসুখ তাড়ানোর দাওয়াই। কবি রনজু রাইমের দৃষ্টিতে কবিতা হচ্ছে—‘তোমাকে সামনে রেখে একবই কবিতা সাজাইহৃদয়ে হৃদয় বেঁধে একতারে জীবন বাজাইকবিতা মগজে নয় হৃদয়ের জানি উপজাতমরমে ইশারা পেয়ে চোখে চোখে হয়েছে আঁতাত।’(অস্পর্শিয়া-৯, পৃ-১৭)ফলে কবির কাছে মনে হয়, কবিতা মানেই মনের শৃঙ্খল অভিব্যক্তি। কবিতা মগজের নয়, হৃদয়ের উপজাত। হৃদয় নিংড়ানো ছন্দময় কথামালাই কবিতা।
আরও পড়ুন
বিষাদের ছায়া: মধ্যবিত্তের জীবন-যন্ত্রণা স্বপ্নের সাথে বৈরিতা: অস্তিত্ব ও আত্মবোধের লড়াইএ ছাড়া তার কবিতায় এসেছে বৈষ্ণব প্রসঙ্গ। চণ্ডীদাস কিংবা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও। আবার রামগিরি কিংবা অলকা। তার প্রেমিকা যেন রাধিকা, ক্লিওপেট্রা বা হেলেনের মতো। তার ভালোবাসায় সাহস জোগান জীবনানন্দ দাশ, কবীর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিনয় মজুমদার। তার প্রেমে উঠে এসেছে সাইবার যুগও। এই যুগ তার কবিতায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। কবির সেই প্রেম যেন একটু ভিন্নতর। খামের বদলে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ। কবির ভাষায় বলা যায়—
‘তোমার উঠানে বসে চ্যাট করে ঘুমবালিকারাসুগার বেবিরা সব বেড়াতে গিয়েছে অন্যপাড়া।’(অস্পর্শিয়া-১৯, পৃ-২৭)কিংবা যখন বলে ওঠেন—‘ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হলো, তুমি নাইমেঘেদের খামে ভরে হৃদয়ের খবর পাঠাই’(অস্পর্শিয়া-২১, পৃ-২৯)কবি আরও বলেছেন সাইবার যুগের প্রেম সম্পর্কে—‘মেক-আপ উঠে গেলে ঘষা কাচে কান্নার মাতমসাইবার যুগ বলে রূপসীরা সাজে খুব কম’(অস্পর্শিয়া-২৫, পৃ-৩৩)
Advertisement
কবি রনজু রাইমের প্রেমে কখনো কখনো হতাশাও ভর করে। নির্বাসিত মনে হয় নিজেকে। বিষণ্ন বিকেলের ছবি আঁকে। বিরহ কাতর বিকেলে প্রেমিকাকে মনে হয় স্বার্থপর। তাই তো কবি বলেন—‘স্পর্শের আগেই তুমি নির্বাসন দিয়েছ আমাকেহতাশ প্রেমের দেবী বাঁচবে কি পরিযায়ী মনএমন নিষ্ঠুর প্রেম শোনে না সে হৃদয়-ক্রন্দনকেবলি বিষণ্ন সে যে বিকেলের ছবি শুধু আঁকে।’(অস্পর্শিয়া-৩২, পৃ-৪০)
কবি রনজু রাইম তার প্রেমের সনেটে উপমা, রূপক, অলংকারে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পুরাণ এবং বর্তমানকে এক সুতোয় গেঁথেছেন। বৈষ্ণব পদাবলি থেকে শুরু করে সাইবার কালের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। তার সনেটের কিছু পঙক্তি পাঠকের অন্তরে ঠাঁই করে নেবে। সেগুলো তাহলে একটু সারিবদ্ধ করে নিচ্ছি—
১. অস্পর্শিয়া হায় তুমি কোন দূর পৃথিবীর মেয়ে (অ-৩৩, পৃ-৪১)২. অস্পর্শিয়া তুমিহীন দেহমনে অদৃশ্য আগুন (অ-৩৬, পৃ-৪৪)৩. নক্ষত্রের হাটে আমি খুঁজেছি তোমাকে সারারাত (অ-৩৭, পৃ-৪৫)৪. বিচ্ছেদের বিষে এই অন্তর হয়েছে গাঢ় নীল (অ-৩৯, পৃ-৪৭)৫. উন্মাদ নগরে এ হৃদয় খুঁজে শুধু তোমাকেই (অ-১, পৃ-৯)৬. বাসনার রঙ দিয়ে তোমাকেই রাঙাবো আবার (অ-৩, পৃ-১১)৭. চোখেমুখে রূপটান অ্যাপসের গুণে ভুলোমন (অ-২৫, পৃ-৩৩)৮. সাইবারকন্যা তুমি তারাদের সঙ্গে খুব সখ্য (অ-২১, পৃ-২৯)৯. বিমূর্ত কবিতা বেয়ে নামে প্রেম অপ্সরার রূপে (অ-১৪, পৃ-২২)১০. মায়ার পৃথিবী জুড়ে প্রেমকাম রয়েছে সঙ্গীন (অ-৪, পৃ-১২)।
উপমা এবং রূপকে এসব পঙক্তি যেন অনবদ্য। কবির দর্শনও এখানে ফুটে ওঠে অনায়াসে। তার প্রেমের ধরন, ধারণ ও উপকরণ খুঁজে পাওয়া যাবে এসব দার্শনিক পঙক্তিমালায়।
তবে বইটি পাঠে একটি প্রশ্ন মনে উদয় হতে পারে। ‘অস্পর্শিয়া’ শিরোনামে লেখা এই চল্লিশটি কবিতা কার জন্য? বইয়ের উৎসর্গপত্রেও খুঁজে পাওয়া যায় ‘অস্পর্শিয়া’কে। তাহলে কে এই অস্পর্শিয়া? প্রথম কবিতায় হয়তো তার কিছুটা আন্দাজ করা যায়। যদিও অস্পর্শিয়া কে? তা কেবল কবিই বলতে পারবেন। তারপরও কবিতা থেকেই একটু পাঠ নেওয়া যাক—
‘অস্পর্শিয়া, তুমি কি মানবী নাকি দেবীর প্রতিমাপ্রমত্ত কবির প্রাণে প্রমাদের স্পর্শহীন সুখনাকি তুমি দুই চোখে মুগ্ধতার বিলাসী অসুখপরিযায়ী প্রেম চিনে নিবে হৃদয়ের বাস্তুসীমা।’(অস্পর্শিয়া-১, পৃ-৯)
অস্পর্শিয়া যে-ই হোক না কেন, আমরা জানবো শুধু—তিনি কবির মানসসঙ্গিনী। তাই ‘অস্পর্শিয়া’ নামক কাব্যগ্রন্থটি হোক পাঠকের আরাধ্য। জগতের সব ভালোবাসা বিরাজ করুক রসিক পাঠকের অন্তরে। সবশেষে বলবো, বইটির প্রচ্ছদ এবং বাঁধাই অনিন্দ্যসুন্দর। মোস্তাফিজ কারিগরের আঁকা প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছে কবিতাসংক্রান্তি। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
এসইউ/জিকেএস