স্বাস্থ্য

ডাউন সিনড্রোম শিশুদের প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা ও পুনর্বাসন

ডাউন সিনড্রোম নিয়ে ২০০৮ সালে জন্ম রাফান রাজ্জাকের। বর্তমানে তার বয়স ১৬ বছর। রাফানের জন্ম রাজধানীর ধানমন্ডির জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে। জন্মের সময়ই সেখানকার চিকিৎসক নবজাতকের পরীক্ষা করাতে বলেন। তারা জানান, শিশুটির মধ্যে কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছে। যেমন- শিশুটি একটু নরম বা তুলতুলে হয়েছে। এরপর পরীক্ষা করা হলে রাফানের ডাউন সিনড্রোম লক্ষণ ধরা পড়ে। তবে এই বিশেষ চাহিদা তাকে দমাতে পারেনি। এখন সে হেসেখেলে দিন কাটাচ্ছে। অন্য সাধারণ শিশুদের মতোই জীবনযাপন করছে সে।

Advertisement

ডাউন সিনড্রোম কোনো রোগ নয়। এটি একটি বংশানুগতিক সমস্যা এবং শরীরে ক্রোমোজোমের বিশেষ ত্রুটির জন্য হয়। এটি জন্মগতভাবেই শিশুর এক ধরনের বিশেষ অবস্থা। তাদের থাকে পৃথক ব্যক্তিত্ব। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির প্রতিটি দেহকোষে ২১তম ক্রোমোজোমে একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যাকে ‘ট্রাইসোমি ২১’ বলা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, তাদের অধিকার আছে, এ ধরনের শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যা ও পুনর্বাসন করা প্রয়োজন।

১৯তম বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস আজ বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ)। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘এন্ড দ্য স্টেরিয়োটাইপ’। বাংলাদেশে প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘চিরাচরিত ধারণা শেষ, প্রবেশগম্যতায় স্মার্ট বাংলাদেশ’। দেশে দিবসটি ১১তম বারের মতো পালন করা হচ্ছে। জন ল্যাংডন ডাউন নামে একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক ১৮৬৬ সালে প্রথমবার এ ধরনের শারীরিক জটিলতার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেন। তাই তার নামানুসারে এ সমস্যাটির নামকরণ হয় ‘ডাউন সিনড্রোম’।

দেশে মায়ের বয়স ২০ বছরের কম বা ৩৫ বছরের বেশি হলে জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে এ ধরনের ঝুঁকি বাড়বে। বয়স যত বেশি হবে শিশুর ডাউন সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে। যেমন- ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন সিনড্রোম শিশুর হতে পারে

Advertisement

বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে প্রতি ৮০০ জন শিশুর মাঝে একজন শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মায় বলে ধারণা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তি রয়েছে প্রায় ৭০ লাখ। বাংলাদেশ সরকারের তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত ছয় হাজার মানুষ পাওয়া গেছে, যারা ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মেছেন। তবে এটি মূল চিত্র নয়।

আরও পড়ুন

শিশুর ডাউন সিনড্রোম হওয়ার কারণ কী? বকাঝকা না করে শিশুকে যেভাবে শাসনে রাখবেন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ডাউন সিনড্রোম নিয়ে তথ্য সংরক্ষণ শুরু করেছে। তবে সরকারের তৈরি ডাটাবেজেও সঠিকভাবে উঠে আসছে না এ সংক্রান্ত তথ্যাদি। সরকারের তথ্যে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মানো মানুষদের বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে। এতে ডাউন সিনড্রোম সমস্যায় থাকা ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য আসছে না।

১৪ বছরের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু আয়েশা আক্তার। জন্মের পর যখন থেকে তার এই বিশেষ চাহিদার কথা চিকিৎসকরা জানান তারপর থেকেই তার মা লাকী বেগম স্বামী ও পরিবারের নানা কটু কথার শিকার হয়েছেন। আয়েশার জন্মের চার বছরের মাথায় তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। লাকী বেগমের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়।

Advertisement

লাকী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আয়েশার জন্মের দেড় মাসের মাথায় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, আয়েশা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। অন্য সবার মতো নরমালি সে চলতে পারবে না। এরপর থেকে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে নানা কটু কথা বলতে শুরু করেন। তার আমার ওপর সব দোষ চাপাতে চায়।

‘আগের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর নতুন করে বিয়ে করেছি। নতুন সংসারে আমার তিন বছর বয়সী একটি ছেলে সন্তান আছে। সে সম্পূর্ণ সুস্থ’- বলেন লাকী বেগম।

বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশে ২০১৬ সালে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি’। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সরদার এ রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, দেশে এখনো ডাউন সিনড্রোমের পরিপূর্ণ তথ্য নেই। আমরা এ ধরনের মানুষদের নিয়ে কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কোনো একটি গ্রামে বা থানায় ২০ হাজার মানুষ থাকলে সেখানে ১৫ থেকে ২০ জনের ডাউন সিনড্রোম রয়েছে। আর তখনই এ তথ্যের সঙ্গে বৈশ্বিক পরিসংখ্যান মিলে যায়।

আরও পড়ুন

দুই লাখ মানুষ ডাউন সিনড্রোমে ভুগছেন ডাউন সিনড্রোম বিশেষ শারীরিক অবস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মগ্রহণ করছে। প্রতিবছর এতজন শিশু এ সমস্যা নিয়ে জন্ম নিলে এই দীর্ঘ সময়ে সংখ্যাটি অনেক বেশি হওয়ার কথা। এছাড়া বৈশ্বিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বছরে ২৫ লাখ শিশুর জন্ম হলে তার মাঝে ২৫০০ থেকে ৩০০০ ডাউন সিনড্রোম। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে তাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই।

ডাউন সিনড্রোম কী?সরদার এ রাজ্জাক বলেন, সাধারণ মানুষের শরীরে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন সেল থাকে। একটি সেলে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মানো শিশুদের ২৩ জোড়াই থাকে। কিন্তু এই বিশেষ মানুষদের শরীরে ২১তম ক্রোমোজোমে তাদের তিনটা ক্রোমোজোম থাকে। আর এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোম শরীরের প্রতিটা সেলেই থাকে। এটি ট্রাইজোমি ২১ কোষ বিভাজনের অস্বাভাবিকতার কারণে হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন, এটি মায়ের সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু এমন ধারণা সঠিক নয়।

বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে প্রতি ৮০০ জন শিশুর মাঝে একজন শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মায় বলে ধারণা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তি রয়েছে প্রায় ৭০ লাখ। বাংলাদেশ সরকারের তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত ছয় হাজার মানুষ পাওয়া গেছে, যারা ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মেছেন। তবে এটি মূল চিত্র নয়

ডাউন সিনড্রোমের ধরনডাউন সিনড্রোমের তিনটি ধরন রয়েছে। যেমন- ট্রিপিক্যাল ডাউন সিনড্রোম, মোজাইক ডাউন সিনড্রোম এবং ট্রান্সলোকেটেড ডাউন সিনড্রোম। সেলের ২১ নম্বর ক্রোমোজোমের প্রতিটিতেই অতিরিক্ত ক্রোমোজোম থাকে। ৯৫ ভাগ ডাউন সিনড্রোমদের ট্রিপিক্যাল ডাউন সিন্ড্রোমের ধরন থাকে। মোজাইক ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোম সব সেলে থাকে না। কিছুটা গ্যাপ দিয়ে দিয়ে থাকে, এ ধরনের ডাউন সিনড্রোমে আছে ২-৩ শতাংশ ব্যক্তির। ট্রান্সলোকেটেড ডাউন সিনড্রোমের শিশুরা জন্মগতভাবে কিছু রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। এরা কিছুটা ক্রিটিক্যাল হয়ে থাকে। এ ধরন থাকে ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে।

ডাউন সিনড্রোমের লক্ষণএ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু জাগো নিউজকে বলেন, এ শিশুগুলো খুব নরম ও তুলতুলে হয়। লো মাসেল টোনের কারণে তাদের শরীর একটু ফোলা ফোলা হয়। অনেকের মধ্যে জিভ একটু বের করে রাখার প্রবণতা থাকে। মুখমণ্ডল ছোট হয়, থুতনি সেভাবে বোঝা যায় না, গলা ছোট হয়। এছাড়া কম উচ্চতা, চোখের কোণা ওপরের দিকে ওঠানো, চ্যাপ্টা নাক, ছোট কান, হাতের তালুতে মাত্র একটি রেখা ও জিভ বের হয়ে থাকা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

এছাড়াও এ ধরনের ব্যক্তিদের কানে কম শোনা, কথা বলতে দেরি হওয়া ও কম বুদ্ধি ইত্যাদি জটিলতা থাকে। তাদের হাঁটাচলা ও মাংসপেশির গঠন সঠিক হয় না। আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তা অনেক কম হয়। কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্তদের অল্প বয়সেই হৃদরোগের সমস্যা হয়।

ডাউন সিনড্রোম শিশুদের সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজনসরদার এ রাজ্জাক জানান, এটি কোনো রোগ নয়, জন্মগতভাবেই হয়ে থাকে। ফলে এর সুনির্দিষ্ট কোনো দাওয়াইও নেই। তবে তাদের থেরাপি দিয়ে ঠিক করা সম্ভব হয়। এমন অনেক শিশু আছে যারা জন্মের দুই থেকে তিনমাস বিছানা থেকেও ওঠেনি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন তারা নদীতেও সাঁতার কাটে। এ ধরনের শিশুদের নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

তিনি বলেন, আমাদের ফাউন্ডেশন এই বিশেষ চাহিদারসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে কাজ করছে। তারা খুবই ইমোশনাল হয়ে থাকে। পাঠ্যসূচির দিকে যেতে চায় না। তবে তাদের শিখিয়ে দিলে তারা করতে পারে। আমাদের এখানে থাকা শিশুরা স্টেজে পারফর্ম করছে। তারা নাচছে, কথা বলছে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মগ্রহণ করছে। প্রতিবছর এতজন শিশু এ সমস্যা নিয়ে জন্ম নিলে এই দীর্ঘ সময়ে সংখ্যাটি অনেক বেশি হওয়ার কথা। এছাড়া বৈশ্বিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বছরে ২৫ লাখ শিশুর জন্ম হলে তার মাঝে ২৫০০ থেকে ৩০০০ ডাউন সিনড্রোম। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে তাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই

বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আরও বলেন, তারা অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের কারণে সবকিছু একটু দেরিতে শেখে। দেরিতে হাঁটাচলা করে, শরীরের গঠনও একটু আলাদা হয়ে থাকে, মুখের অংশ একটু চাপা থাকে। জিভ অনেক সময় বেরিয়ে থাকে। এসব সমস্যা অনেক সময় থেরাপি দিয়ে ঠিক করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন

ডাউন সিনড্রোম শিশু-কিশোরদের পুনর্বাসন নিশ্চিতের আহ্বান মাতৃগর্ভের ভ্রূণ ত্রুটিপূর্ণ কি না, জানা যাবে স্ক্রিনিংয়ে

তিনি মনে করেন, দেশে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মানো শিশুদের জন্য আলাদাভাবে ডেডিকেটেড হাসপাতাল থাকলে সেখানে তাদের চিকিৎসা করা সহজ হবে। তাদের রোগবালাই সাধারণ মানুষের মতো হলেও তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি কিছুটা আলাদা হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, আমাদের দেশে মায়ের বয়স ২০ বছরের কম বা ৩৫ বছরের বেশি হলে জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে এ ধরনের ঝুঁকি বাড়বে। বয়স যত বেশি হবে শিশুর ডাউন সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে। যেমন- ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন সিনড্রোম শিশুর হতে পারে।

তিনি বলেন, কোনো মায়ের আগে একটি ডাউন সিনড্রোম শিশু থাকলে পরের শিশুটিরও এ ধরনের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বাবা-মা ত্রুটিযুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে তাদের সন্তানও ডাউন শিশু হতে পারে। যদি বাহক বাবা হন তবে সেক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে ৩ শতাংশ আর বাহক মা হলে ঝুঁকি বেড়ে হয়ে যায় ১২ শতাংশ।

এএএম/এমকেআর/এএসএম