গলায় প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ফরিদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জেনারেল হাসপাতালে যান হাসিনা বেগম (৩৯)। সেখানে ভোগান্তি যেন শুরু থেকেই পিছু নেয় তার। বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ লাইন, কিন্তু কাউন্টারে কোনো লোক নেই। কিছুক্ষণ পর এলেন। এরপর বহু কষ্টে একটি টিকিট কেটে হাসিনা বেগম পৌঁছালেন পুরনো ভবনে ইএনটি বিভাগে ডাক্তারের নির্দিষ্ট কক্ষে। বয়সে তরুণ হলেও এরইমধ্যে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক তাকে দেখে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। কয়েক প্রকারের ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি ওষুধটি অবশ্য হাসপাতাল থেকেই ফ্রিতে পাওয়া গেলো। আরও প্রায় তিনশো টাকার ওষুধ কিনলেন বাইরের ফার্মেসি থেকে।
Advertisement
কয়েকদিন এসব ওষুধ সেবনের পরও যখন তার উন্নতি হচ্ছিল না তখন তিনি শরণাপন্ন হলেন আরেকজন চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে। ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক ৭০০ টাকা ভিজিটে বিকেলের পর রোগী দেখেন। তিনি হাসিনা বেগমকে দেখে জানালেন, গলায় ইনফেকশন হয়ে গেছে। এরপর কিছু ওষুধপথ্য লিখে দিলেন। ডাক্তারি ফি আর ওষুধ মিলিয়ে এবার খরচ হলো ২১০০ টাকা। এসব ওষুধ সেবনের দিনকতক পরে সুস্থ হলেন তিনি।
হাসিনা বেগমের প্রশ্ন, জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তারি ফি নেওয়া হয় না বলেই কি রোগীদের প্রতি কোনো দায় বোধ থাকে না?
বস্তুত এমন প্রশ্ন শুধু হাসিনা বেগমের একার নয়, একই প্রশ্ন এই জনপদের হাজার হাজার ভুক্তভোগী দরিদ্র রোগীর। যারা হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য না থাকায় প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন সরকারি এই হাসপাতালের বারান্দায়। তারপর রোগভোগে ত্রাহি দশা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন। এদের কেউ কপালগুণে সুচিকিৎসা পান। কেউবা প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের দালালদের খপ্পরে পড়ে টাকাপয়সার সঙ্গে জীবনটাও হারান।
Advertisement
খবর নিয়ে জানা গেছে, জেলা সদরের শত বছরের প্রাচীন জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন কয়েকশ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। যার বেশিরভাগই বহির্বিভাগের। একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের পরও এই জেনারেল হাসপাতালটির আবেদন এখনো কমেনি। বরং দিনে দিনে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে রোগীর চাপ বাড়ছেই। অথচ হাসপাতালে রোগ ডায়াগনস্টিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আলট্রাসনোগ্রাম ও এক্সরে সেবা বন্ধ। এনালগ এক্সরে মেশিনে টুকটাক কাজ হলেও ডিজিটাল মেশিনটি পড়ে আছে টেকনিশিয়ানের অভাবে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার ফলে সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংক অফিসার নেই। একজন ব্রাদারের ইনচার্জে চলছে ব্লাড ব্যাংক ও প্যাথলজি বিভাগ।
জনবল সংকট চরমে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ৩৭ পদের বিপরীতে আছেন ১৬ জন চিকিৎসক। গাইনি, কার্ডিওলজি ও মেডিকেল অফিসার ছাড়া মেডিসিন, ইএনটি, শিশু, সার্জারি, চক্ষু, অর্থোপেডিক্স প্যাথলজি, চর্ম ও যৌন এবং রেডিওলজিস্টসহ ২১ বিভাগে কোনো কনসালটেন্ট নেই বছরের পর বছর। সেবা তত্ত্বাবধায়ক ও উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক পদ দুটি খালি। অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই ১০ বছর ধরে।
সহকারী রেজিস্ট্রার মেডিসিন ও ব্লাড ব্যাংক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ হয়নি কখনোই। ফার্মাসিস্ট, অফিস সহায়ক, বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ওয়ার্ড মাস্টারের পদগুলোর অর্ধেকই খালি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৩০ পদে ১৬০ জনের বিপরীতে আছেন ১১৯ জন। নেই কোনো নিরাপত্তারক্ষী বা নৈশপ্রহরী।
বন্ধ আলট্রাসনোগ্রাম, অচল এক্সরে মেশিন
Advertisement
জেনারেল হাসপাতালটিতে টেকনিশিয়ান না থাকায় হাসপাতালের আলট্রাসনোগ্রাম বন্ধ। ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটিও অচল। প্যাথলজি বিভাগের চার্টে ২৩টি টেস্টের কথা উল্লেখ থাকলেও এর মধ্যে প্লাটিলেট, পিবিএফ, ব্লাড ইউরিয়া, কোলেস্টেরল ও স্টুলের রুটিন পরীক্ষা হয় না। হাসপাতালটিতে নেই আইসিইউ বা সিসিইউ ইউনিট। পরিচালনা ও মেরামতকারীর অভাবে ব্যবহার হয় না যন্ত্রপাতিও।
ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হাসপাতালের পরিবেশের অবস্থাও ভয়াবহ। গুরুতর রোগী ভর্তি করা হয় না বলে সার্জারি ওয়ার্ডটি খালিই পড়ে থাকে। অন্যান্য ওয়ার্ডেও রোগীর ভিড় না থাকলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার তীব্র অভাব রয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশন পরিস্থিতির। আবর্জনা পরিষ্কারের ২ কোটি টাকা বকেয়া থাকায় পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লা আবর্জনা অপসারণ করেন না। ফলে হাসপাতাল এলাকার অভ্যন্তরে ময়লা আবর্জনা ও মেডিকেল বর্জ্যের স্তূপে চলাচল করাই দুরূহ। পেছনের এলাকায় বনজঙ্গল আর গাঁজার বাগান হয়ে উঠেছে।
এদিকে হাসপাতালের আরএমওর সাবেক কোয়ার্টারের তিনতলা ভবন এবং স্টাফদের আরেকটি চারতলা কোয়ার্টার ভবনটিও পরিত্যক্ত পড়ে আছে। সেখানে ভবনগুলোর দরজা-জানালা এমনকি ইট-রড খুলে খুলে বিক্রি করে দিচ্ছে কে বা কারা। এছাড়া হাসপাতালটিতে চুরি-ছিনতাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবুও রয়েছে কিছু সুনাম নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থাকার পরও হাসপাতালটিতে এখনো রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন নিরুপায় হয়ে। অবশ্য হাসপাতালটির শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুর রাজ্জাক রোগীদের কাছে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একজন আস্থাশীল চিকিৎসক হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু এবং ডোপ টেস্ট করা হয় ফ্রিতে। হাসপাতালে বেশ কয়েকটি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি ও জেলা শহরের সবচেয়ে উন্নত অপারেশন থিয়েটার রয়েছে।
প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই এই দশা প্রায় একশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটিতে ১৯৩৯ সালে পুরুষ ও নারী ওয়ার্ড চালু করা হয়। এরপর থেকে এটিই ছিল অত্রাঞ্চলের মানুষের চিকিৎসার আশা ভরসা। একটা সময় সেবার মানে এটি ছিল প্রথম সারিতে। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালটিকে অকেজো করে রাখা হয়েছে বলে শহরবাসীর অভিমত। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিককে সুবিধা করে দিতেই হাসপাতালটির সেবার মান উন্নয়ন করা হয় না বলে তাদের অভিমত। অথচ এখনো গড়ে প্রতিদিনে ৮০০’র মতো রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন এখানে।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে সার্জারি (নারী ও পুরুষ), মেডিসিন (নারী ও পুরুষ), পেয়িং, গাইনি, শিশু, ডায়রিয়াসহ আটটি ওয়ার্ডে গড়ে প্রতিদিন ১২০ জনের মতো রোগী ভর্তি থাকেন। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা হলো, বেশিরভাগের কপালে জোটে না সেবা। অনেক রোগী ফিরে যান। গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা জটিল রোগে আক্রান্ত কেউ এলে, তাকেও ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুরো হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য। অনেক সময় তারা রোগী ভাগিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে যান। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সারি বেধে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের লেখা রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলেন।
ফরিদপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর এই হাসপাতালটিকে বন্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। সেসময় শহরবাসীর দাবির মুখে হাসপাতালটিকে প্রথমে ৫০ শয্যার এবং পরে একশো শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। তবে নানা সংকটে হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগে আক্রান্ত।
এ ব্যাপারে জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. গণেশ কুমার আগারওয়ালা জানান, রেডিওলজির অ্যানালগ ছাড়া তাদের এখানে কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ডিজিটাল মেশিন থাকলেও তা শুরু থেকেই কর্মীর অভাবে বিকল হয়ে গেছে। নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় চুরি ঠেকানো যায় না। প্রাইভেট চেম্বার করলেও এখানকার কোনো চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত নেই বলে তার দাবি।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট ও অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ না থাকায় চিকিৎসার পাশাপাশি অস্ত্রোপচারে সমস্যা হচ্ছে। প্রতি মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র দিয়েও সুফল মেলে না।
এফএ/এএসএম