মতামত

যেসব কারণে চিকিৎসকরা গ্রামে যেতে চান না

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসকরা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তবে চিকিৎসকের স্বল্পতার জন্য অধিকাংশ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকদের নিয়োগ দিতে পারে না সরকার। সে হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হলো চিকিৎসকদের সর্বনিম্ন পদায়নের জায়গা। কিন্তু সেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও চিকিৎসক সংকটে ভুগছে।

Advertisement

একজন চিকিৎসক যখন পাঁচ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এমবিবিএস পাস তখন তাঁকে আবার বিসিএসের কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয়। অন্য সাধারণ প্রার্থীদের মতো বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস পাস উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দিতে হয়। কিন্তু এতো পরিশ্রমের পর চাকরিতে যোগ দিতে সেখানে কয়েক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়।

১. বাসস্থানের অভাবএর মধ্যে রয়েছে প্রথম বাসস্থানের অভাব। চিকিৎসকদের জন্য যেসব বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয় সেগুলো জরাজীর্ণ, অনেক পুরাতন। পানির লাইন থেকে শুরু করে টয়লেট সব অপরিষ্কার। বেশিরভাগ ব্যাঙ ও পোকা-মাকড় দিয়ে ভরা। তাই বাধ্য হয়ে অন্য কোথাও নিজের টাকা খরচ করে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়।

২. নিরাপত্তার অভাব একজন ডাক্তারের প্রান্তিক পর্যায়ে সবচেয়ে যে জিনিসটির জন্য ভোগেন তা হলো নিরাপত্তাহীনতা। কোনো খারাপ রোগী আসলে চিকিৎসা দেয়ার পর মারা গেলে- ডাক্তারের দোষ, বেশি খারাপ রোগী রেফার করলে- কেন চিকিৎসা না দিয়ে রেফার করলেন, সেই দাবি তুলে ডাক্তারের উপর শারীরিক আঘাত, রোগী মারা গেলে- ডেথ ডিকলার করলে শুরু হয় ভাংচুর।

Advertisement

আশার কথা হচ্ছে- আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ডাক্তাররা কেন গ্রামে থাকেন না, সে কারণ উনি দেখবেন, এরপর ব্যবস্থা নিবেন। আমরাও এটাই আশা করি, ঢালাওভাবে কোনো কিছু যেন না করা হয়, ডাক্তারদের কথা শুনুন- কেন তারা গ্রামে থাকতে চান না, কেন ২ বছর কোনো রকমে পার করার চেষ্টায় থাকেন।

এছাড়া এলাকার নেতা, পাতি নেতা, চেয়ারম্যান, মেম্বার, বখাটে সবাই সব দাবি (ন্যায়, অন্যায়, জোর করে ভর্তি, সার্টিফিকেট দেয়া, প্রতিবন্ধী না হবার পরেও তার সার্টিফিকেট) এসে ফলান ডাক্তারের কাছে। কেউ এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তার জন্য সেখানে চাকুরি করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ সন্ধ্যা ও রাতে ডিউটি থাকে হাসপাতালে যাওয়া-আসার রাস্তায় খুব বাজেভাবে হ্যারেস, শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়।

৩. ডাক্তার বা হাসপাতালের উপর ঘটিত অপরাধগুলোর বিচার না হওয়া

হাসপাতালে আক্রমণ, চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা, সরকারী সম্পত্তি বিনষ্ট করা ইত্যাদির বিচার হয় না। একজন রোগী মারা গেলে যেভাবেই মারা যাক অতি দ্রুত ডাক্তারকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু ডাক্তারকে আঘাত করলে এমনকি মেরে ফেললেও মামলা নিতে দেরী এবং অপরাধীকে গ্রেফতার করতে গড়িমসি করা হয়। যার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে জৈন্তাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তাদের সরকারী হাসপাতালে আক্রমণ এবং সরকারী সম্পত্তি নষ্ট করার পরেও আসামী গ্রেফতার না হওয়া।

Advertisement

এছাড়াও আরও অনেক সমস্যা রয়েছে-চীনে এক সময় দেখা গেল প্রান্তিক এলাকার মানুষ স্বাস্থ্য সেবা কম পাচ্ছে। যে কারণে সেখানে স্বাস্থ্যগত জটিলতা বেশি হচ্ছে। মানুষের হার্ট অ্যাটাক, কিডনী নষ্ট, পঙ্গুত্ব বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য আসার পর চায়না সরকার এটা নিয়ে কাজ শুরু করেন। উনারা প্রথমেই কমিউনিটি বেজড সেন্টার করেন যেখানে মানুষের সকল প্রাইমারি স্বাস্থ্য সেবা দেয়া যায়। এরপর সেই কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে যেন ডাক্তার ও অন্যান্য স্টাফ থাকেন তার ব্যবস্থা করেন।

যেসব ডাক্তার বা স্টাফ এসব কমিউনিটি সেন্টারে চাকুরি করবেন তাদের জন্য বাসস্থান, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা শহরের ডাক্তার বা স্টাফের চেয়ে বেশি দেন। ফলে কমিউনিটি সেন্টারগুলো খুব ভালোভাবে রান করে, মানুষ নিজেদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার অধিকাংশই নিজের বাড়ির কাছে পেয়ে যান। ফলে স্বাস্থ্য সেবা উন্নত হয়। একটু সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আশার কথা হচ্ছে- আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ডাক্তাররা কেন গ্রামে থাকেন না, সে কারণ উনি দেখবেন, এরপর ব্যবস্থা নিবেন। আমরাও এটাই আশা করি, ঢালাওভাবে কোনো কিছু যেন না করা হয়, ডাক্তারদের কথা শুনুন- কেন তারা গ্রামে থাকতে চান না, কেন ২ বছর কোনো রকমে পার করার চেষ্টায় থাকেন।

মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন- বিদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখুন, কারা কোনো ধাপে থাকবেন, কারা কতটুকু চিকিৎসা সেবা দিবেন, চিকিৎসকদের কিভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়, কিভাবে রোগীদেরকে চিকিৎসা নেয়ার উপযুক্ত করা যায়, কিভাবে শুধু শুধু ফ্রি ঔষধ নেয়া সরকারী হাসপাতাল থেকে বন্ধ করা যায় এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বাঁচান, চিকিৎসকদের বাঁচান, আমরা ডাক্তাররা এই আদিমকালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, শুধু মানুষের গালি খেয়ে চিকিৎসা দিতে চাই না।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/এএসএম