মতামত

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি সর্বজনীন?

বিদেশি কূটনীতিকরা প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নেন। এটা খুবই দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এমন একটি শক্তিশালী ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু মহলের অপতৎপরতায় সেই সম্পর্ক ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের লেখা একটি কলাম ছাপা হয়েছে সম্প্রতি দেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে। ইংরেজিতে ‘দি ইউএস স্টিল কেয়ারস ডিপলি অ্যাবাউট ডেমোক্রেসি’ কলামে পিটার হাস গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকারসহ বাংলাদেশের নানান অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

Advertisement

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বাংলাদেশ ও সর্বত্র গণতন্ত্রের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। তিনি উল্লেখ করেছেন, আমরা চাপ অব্যাহত রাখব, যাতে বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতা বজায় থাকে এবং আমরা আরও উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজের পথকে সুগম করতে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানানো অব্যাহত রাখব। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন লক্ষ্য রয়েছে, এমন ক্ষেত্রগুলো খুঁজে বের করব। এ বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ যে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক একই গতিতে এগিয়ে যেতে চায়।

মূলত সম্প্রতি হয়ে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ থেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ নানান ইস্যুতে বারবারই হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন পিটার হাস। আর এ কাজে তাকে উপযুক্ত সহযোগিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত সুশীল সমাজ নামধারী একশ্রেণির অতি উৎসাহী ব্যক্তিরা। যদিও পিটার হাস ও অতি উৎসাহী দেশীয় সহযোগীদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সর্বশেষ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

পিটার হাসের কলামের মাধ্যমে তিনি যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা প্রকাশ করেছেন- তা কি বিশ্ববাসীর জন্য সর্বজনীন? আমরা যদি উল্লেখ করি, সর্বশেষ ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বর্বর গণহত্যায় মদত দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি দ্বিমুখিতা এবং আত্মপ্রতারণা নয়? গাজায় গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অব্যাহত ইসরায়েলি গণহত্যায় নিহত হয়েছেন ৩১ হাজার ফিলিস্তিনি। যাদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এমনকি অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে।

Advertisement

অনেকদিন কিছুটা নীরব অবস্থানে ছিল পিটার হাস। কারণ এরই মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যেখানে তিনি দুই দেশের মধ্যে ‘নতুন অধ্যায়ের’ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। নতুন অধ্যায়টি কী হবে- সে বিষয়েও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের একটি দেশ হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এজন্য বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যেমন বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছে সরকার।

কিন্তু হঠাৎ করে সম্প্রতি প্রকাশিত পিটার হাসের লেখা কলামে বিতর্কিত অবস্থান দৃশ্যমান হয়েছে। এক ধরনের সবিরোধী বক্তব্য তার লেখায় উপস্থাপিত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বারবারই পিটার হাসের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও ওয়াশিংটনে বসে থাকা তার নীতি নির্ধারকদের সুদৃষ্টি আকর্ষণের আকাঙ্ক্ষাও জড়িত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। হঠাৎ পুনরায় তার এ সরব অবস্থান প্রমাণ করে যে তিনি আবার সামনে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু সেটি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলে, নিশ্চয়ই তা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল হবে। নির্বাচনের পরও বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের ওপর তিনি প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন। তিনি যত দিন বাংলাদেশে থাকবেন তত দিন তিনি এসব করতেই থাকবেন বলে ধারণা করা যায়। এর সঙ্গে হয়তো তার ক্যারিয়ারের উন্নতির বিষয়টিও জড়িত।

পিটার হাসের কলামের মাধ্যমে তিনি যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা প্রকাশ করেছেন- তা কি বিশ্ববাসীর জন্য সর্বজনীন? আমরা যদি উল্লেখ করি, সর্বশেষ ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বর্বর গণহত্যায় মদত দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি দ্বিমুখিতা এবং আত্মপ্রতারণা নয়? গাজায় গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অব্যাহত ইসরায়েলি গণহত্যায় নিহত হয়েছেন ৩১ হাজার ফিলিস্তিনি। যাদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এমনকি অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। যুক্তরাষ্ট্র যে এ গণহত্যা স্পষ্টভাবে মদত দিচ্ছে তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট। মানবিধাকারের এবং গণতন্ত্রের যে বুলি যুক্তরাষ্ট্র দিনের পর দিন দিয়ে চলেছে- তা কি নির্লজ্জতার শামিল নয়?

এই যখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের প্রকৃত চিত্র, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পিটার হাসের কলামে বাংলাদেশকে দেওয়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সবক কতটা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা চুক্তির ৪১ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কূটনীতিকদের দায়িত্ব হলো গ্রহীতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।”

Advertisement

এটি কোনো প্রথা বা সৌজন্যতার বিধি নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক বিধান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, হস্তক্ষেপের অভিযোগে গ্রহীতা রাষ্ট্র কূটনীতিকদের সতর্কতা, বহিষ্কার এবং এমনকি কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত কোনো কোনো পশ্চিমা দূতাবাস রাজনৈতিক সংগঠনের মতো মাঠে নেমেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলে এবং বাংলাদেশে আজ্ঞাবহ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে নানা অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত।

মার্কিন প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় আড়াইশ সাংবাদিককে গ্রেফতার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর বাইরে শত শত সাংবাদিক বৈষম্য, শারীরিক নির্যাতন, আক্রমণ ও হুমকি-ধামকির শিকার হয়েছেন। মানবাধিকারের মূলনীতি সাম্য ও বৈষম্যহীনতা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা এখনও অনেক দূরে। এই তো কয়েক দশক আগেও ইউরোপের অনেক দেশে আফ্রিকার কালো মানুষদের খাঁচাবন্দি করে আনন্দ উপভোগ করা হতো। বর্ণবাদ সমাজ ও রাজনীতির গভীরে প্রোথিত রয়েছে এসব দেশে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অজুহাত তুলে পিটার হাসের বক্তব্য এক ধরনের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ। আজকাল হামেশাই খবর বেরোয় বিএনপি নেতা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। বৈঠক শেষে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি নেতাদের ছবি ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। এসব কিছু কোনোভাবেই রাজনীতির আদর্শিক শিষ্টাচার নয়। এ বিষয়ে সবার আচরণ বিধিসম্মত, ন্যায়নীতিভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনের মূল্যবোধ অনুসরণ করে চলা উচিত।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। sultanmahmud.rana@gmail.com

এইচআর/ফারুক/এএসএম