আমাদের গ্রামের বাড়িতে এখনও কিছু দেশি চিকন ধানের আবাদ হয়। শৈশবে হেমন্তকালে দেখতাম খুলিবাড়ি বা বাইরের উঠানে জমি থেকে কেটে আনা বিভিন্ন জাতের পাকা ধানের আঁটির জন্য ভিন্ন ভিন্ন পুঞ্জ। সেগুলো মাড়াই করতে করতে মাসাধিক কালক্ষেপণ করা হতো। সবার আগে ইরি জাতের মোটা ধান মাড়াই করা হতো বাজারে বিক্রির জন্য।
Advertisement
কার্তিকের শেষ পর্যন্ত দেশি জাতের ধান পাকতো না। তাই বাজারে মোটা চালের কিছুটা দাম বেশি পাওয়া যেত বলে কৃষকরা ইরি জাতের মোটা ধান আবাদ করতেন। এরপর সুগন্ধি জাতের ভোগধান, জামাইআদুরি, কলোজিরা, তুলশীমালার মাড়াই করে সংরক্ষণ করা হতো। কারণ সুগন্ধি ধানের ক্ষেতে যেমন পাখি ও পতঙ্গের আক্রমণ বেশি হতো তেমনি পাকা ধান কেটে উঠানে এনে রাখার পর আঁটির পুঞ্জে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হতো।
দেশি জাতের আমন ধানের পুঞ্জিগুলো ফাল্গুন-চৈত্রে মাড়াই করে গোলায় রাখা হতো। কারণ সেসময় আবহাওয়া বেশি শুষ্ক থাকায় ধান এমনিতেই শুকিয়ে যেত। প্রাকৃতিকভাবে শুকনো ধান বীজের জন্য বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখা হতো। সেসব দেশি আমন ধানের চালের ভাত নরম ও বেশ স্বুস্বাদু।
বিশেষ করে দেশি আমন ধানের মধ্যে পত্মী, গতাডুংরা, নোয়াডাং, ঢ্যাপা, নাইড়োলঝোপা নাম আমার এখনও স্মরণে আছে। সারা বছর ধরে পরিবারের খাবারের জোগান দেবে এমন সমপরিমাণ গোলায় রেখে বাকি আমনধানগুলো নতুন বোরা ধান আসার আগে বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এসব ছিল অবস্থাপন্ন সব কৃষকের মধ্যে একটা সাধারণ প্রাক্টিস। পরে তারা আউস ও বোরা মৌসুমে উচ্চফলনশীল ইরি আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়লে ঐতিহ্যবাহী আমন ধানের জাতগুলো বিলুপ্তির দিকে চলে যায়।
Advertisement
এরপর আসে বিরি জাতের নানা প্রকার নতুন ধান। আমার পিতা সরকারি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন বিধায় নতুন জাতের ধানবীজ অথবা সবজির উদ্ভাবন হলে সেগুলো নিয়ে গল্প করতেন এবং বাসায় সেসবের ছবি, বই ও লিফলেট আনতেন। সেই সুবাদে স্কুলে পড়ার সময় সেসব বই-লিফলেট পড়ে বিভিন্ন ফসলের নতুন জাত সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানা হতো। সেই সূত্রেই হয়তোবা আমি এখনও বাগানে সবজি ও ফুলের চাষ করি।
ফিলিপিন্স থেকে পাঁচ নম্বর ইরি ধানের বীজ আমদানির পরে বাংলাদেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে উন্নত জাতের ইরিধান আবিষ্কার করতে শুরু করে। যেগুলো ব্রি নামে পরিচিতি পায়। বিরি ধানের বিভিন্ন জাত যেমন, চান্দিনা, ব্রিবালাম, মালা, চায়না ইরি এবং পরে হাইব্রিড জাতের ব্রি- ২৭, ২৮, ৩০ আরা অনেক নতুন জাতের ধানে আগমন ঘটে। বর্তমান আরও অনেক নতুন উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ঘটেছে। এগুলোর বিঘাপ্রতি ফলন অনেক বেশি হওয়ায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অগণিত মুখের খাদ্য চাহিদা মেটাতে মানুষ ব্রি ধানের আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। হারিয়ে গেছে স্বুস্বাদু দেশি জাতের আউস, আমন ধানের বনেদী জাতগুলো। বিলুপ্তি ঘটেছে প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভাবিত সুগন্ধি ধানেরও।
দুই দশক ধরে বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে হাইব্রিড ইরি ধানের চাল। গবেষণাগারে ইরি ধানের উদ্ভাবন হয়েছিল ভাতের অভাব মেটানোর জন্য। কালক্রমে ইরিধান সর্বপ্রকার দেশি ধান গ্রাস করেছে। দেশি জাতের ধানের ফলন কম হওয়ায় বর্তমানে কৃষকরা ইরিধান ব্যতীত অন্য কোনো ধান উৎপাদনে আগ্রহী নন। কিন্তু ইরিচাল মোটা ও খেতে স্বুস্বাদু না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চালাকি করে সেগুলোকে মেশিনের মাধ্যমে পলিশ করে ভোক্তাদের কাছে নানা কৌশলে ভোগের আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে।
আর এতেই ঘটছে বিপত্তি। কারণ, চালের নতুন নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন ধান থেকে কোন নামের চাল উৎপাদিত হয় সেটা বিক্রেতা বা ভোক্তা কেউই জানেন না। শুধু কৃত্রিম চাল উৎপাদনকারীরা সেটা জানেন। তারা সে বিষয়ে সঠিক তথ্য গোপন করে বাজারে চাল বিক্রি করতে তৎপর।
Advertisement
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, দেশে মিনিকেট নামে আদতে কোনো ধান নেই। একসময় ভারত থেকে ছোট ছোট পুঁটলি বা মিনি প্যাকেটে হাইব্রিড ইরিজাতীয় ধানের বীজ বাংলাদেশে এসেছিল। সেগুলো থেকে উৎপাদিত ধানকে মিনিকেট বলার অপচেষ্টা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু ‘বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত ধান আরও বেশি উচ্চফলনশীল ও লাভজনক প্রমাণিত হওয়ায় আমাদের দেশের কৃষকরা স্থানীয় বা বিরি জাতগুলোকেই বেশি পরিমাণে আবাদ করছেন। মোটা চাল মেশিনে চিকন করে মিনিকেট নামে বিক্রি করছে মিল মালিকরা। ইরি চাল ছেঁটে চিকন-সরু করে বাতাসে আবরণ উড়িয়ে দিয়ে চকচকে মনোলোভা বানিয়ে বাহারি রঙের বস্তায় ভরে বাজারে বিক্রি করছেন।
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের এক গবেষণায় বাজার থেকে জনপ্রিয় আটটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট নামের চালের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সব ব্র্যান্ডের চালই মোটা চাল কেটে-ছেঁটে পলিশ করে চিকন করা হয়েছে। স্বাভাবিক চাল থেকে যে ফ্যাট ও ভিটামিন বি-২সহ যেসব খাদ্য ক্যালরি পাওয়ার কথা, বাজারে বিক্রি হওয়া মিনিকেটে তার কিছুই নেই।
বাংলাদেশ অটো রাইস ও মেজর হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও রশিদ অ্যাগ্রো ফুডের ওপর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘তারাই প্রথম আধুনিক মেশিনে মোটা চাল চিকন করে মিনিকেট নামে বাজারে ছাড়া শুরু করেন। ধান ও কৃষির সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও এ তথ্য স্বীকার করেছে।’
পুষ্টি আবরণ তুলে মোটা ইরি চালকে স্লিম বানিয়ে ও কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহার করে বিক্রি করা ভোক্তার সাথে প্রতারণার শামিল ও অধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়া জিআই পণ্য হিসেবে আমাদের রপ্তানিকৃত সুগন্ধি ধান বাংলামোতি, তুলশীমালা, জামাইআদুরী, কালোভোগের চালও বিদেশের মাটিতে অন্য দেশের সুগন্ধি চালের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। এসব মিনিকেটের অতিমুনাফা ও মেগাক্ষতি খতিয়ে দেখার দায়িত্বটা আসলে কার?
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কুষ্টিয়া জেলা সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ধারণা রয়েছে মোটা চাল কেটে ছোট করা হয়। আমরা মিডিয়ায়ও তেমনি দেখি। কিন্তু আমার জানামতে এমন কোনো মেশিন নেই যাতে মোটা চাল কেটে চিকন করা যায় বা চিকন চাল কেটে আরও সরু করা হয়।’ ... ‘আগে ঢেকিছাঁটা চালে ভাত রান্নার সময় মাড় হতো। এখন হয় না, কারণ যা থেকে মাড় হবে সবগুলো পলিশ মেশিনে বের হয়ে যাচ্ছে। গুঁড়া আকারের এই অবশেষ থেকে এখন তৈরি হয় রাইস ব্র্যান্ড অয়েল। এ দিয়ে মাছ ও গবাদি পশুর খাবারও তৈরি হচ্ছে।’
চালকল মালিকরা প্রকাশ্যেই মোটা চাল মেশিনে দিয়ে চারপাশ থেকে ছেঁটে ফেলে চিকন করে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল লতা, পাজাম ও ব্রি-২৮ নামে বিক্রি করছেন। কম দামের মোটা চাল চিকন করে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা করে বাড়তি দাম পাচ্ছেন মিল মালিকরা। চালের ছেঁটে ফেলা অংশ চালের গুঁড়ি হিসেবে বিক্রি করে পাচ্ছেন বাড়তি মুনাফা। চালকল মালিকদের এ রমরমা বাণিজ্যের উল্টো দিকে ঠকছেন ক্রেতারা। মোটা চালের ভেতরের অংশ বেশি দামে কেনা ছাড়াও চালের উপরিভাগে যে পুষ্টি থাকে, তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন নকল চিকন চাল খাওয়া ক্রেতারা।
বিশেষজ্ঞদের মত, চালের উপরিভাগের আবরণেই প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল বেশি থাকে। আর পুরো চালেই থাকে কার্বোহাইড্রেট। চাল সরু করতে উপরের আবরণ তুলে ফেলায় হারিয়ে যায় প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল।
আগের দিনে মোটা চালের ভাতের কদর ছিল মধ্যবিত্তের ঘরে। তবে দিন বদলের পালায় মোটা চালের জায়গা দখল করে নিচ্ছে চিকন চাল। একসময় ঢেকিছাঁটা চাল খেত মানুষ। সেই চালের ওপর ময়লাজাতীয় একটা বাদামি আবরণ থাকত। এরপরে এলো হাসকিং মিল। এতে চাল পরিষ্কার হতো। এই চালটি অটোমেটিক কালার সর্টার মেশিনে দিলে আরও পরিষ্কার হয় ও পাতলা হয়ে যায়। চালটি দেখতে বেশ চকচকে হয়।’
সরু চাল আরও সরু বানিয়ে কৃত্রিম সুগন্ধি মেখে পোলাও চাল বলে বাজারে বিক্রি করছেন অনেকে। এসব পোলাও চালের পোলাও রান্না করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ছেন রাঁধুনীরা। সাধারণত পোলাও রান্নার আগে চাল ভালোভাবে ধুয়ে পানি নিংড়িয়ে রান্না করতে অভ্যস্ত অনেক রাঁধুনী। কিন্তু প্যাকেটজাত পোলাও চাল ধুয়ে পানি নিংড়িয়ে রান্নার পর আর কোন সুগন্ধি পাওয়া যায় না। অধিকিন্তু, সেই চালে ঘি ঢেলে পোলাও রান্নার পর মুখে আসল পোলাওয়ের স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি রাইসকুকারে মিনিকেট নামের চালের ভাত রান্না করার পর শক্ত হয়ে যায়, যা দ্বিতীয়বার খাওয়া মুশকিল।
ভাতে- মাছে বাঙালি বলে কথাটা অতি পুরোনো হলেও এখনও অতি সত্য। বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য নানা প্রকার বিলাসী খাদ্যতালিকা থাকলেও ভাত প্রধানতম অনুষঙ্গ। হাজারো বিদেশি খাবারের তালিকা সামনে দিলেও বাঙালির ভাত ছাড়া একদিনও চলে না। তবে চাষের হাইব্রিড মাছের সাথে ধান, সবজি সবকিছুই হাইব্রিড, জিএম, ই-এম ফুড ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় ভাতের চিরায়ত স্বাদ ও গুণ হারিয়ে গেছে।
প্রাকৃতিকভাবে চাষকরা সুগন্ধি চালের ভাত-পোলাও এখন অতীতের কল্পনায় বর্তমানের অলীক খোরাক। সুগন্ধি চিকন চাল এখন জমিতে ফলে না- মেশিনে ফলে, আর বাজারে মেলে! সেই চালের ভাতে নেই কোনো প্রেটিন, ভিটামিন, মিনেরাল। পুষ্টিমাণ হারিয়ে যাওয়া নকল-কৃত্রিম পলিশ করা চিকন চালের ভাত খেয়ে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে ফেলছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী মোটাচাল ছেঁটে মিনিকাট করে অতিমুনাফা করলেও প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ হারিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে ভেতো বাঙালির মেগা ক্ষতি করছে।
পুষ্টি আবরণ তুলে মোটা ইরি চালকে স্লিম বানিয়ে ও কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহার করে বিক্রি করা ভোক্তার সাথে প্রতারণার শামিল ও অধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়া জিআই পণ্য হিসেবে আমাদের রপ্তানি করা সুগন্ধি ধান বাংলামোতি, তুলশীমালা, জামাইআদুরী, কালোভোগ ইত্যাদির চালও বিদেশের মাটিতে অন্য দেশের সুগন্ধি চালের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে। এসব মিনিকেটের অতিমুনাফা ও মেগাক্ষতি খতিয়ে দেখার দায়িত্বটা আসলে কার?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/ফারুক/জিকেএস