দেশজুড়ে

গোল চত্বরের অপরিকল্পিত স্থাপনা ট্রাফিকের ‘বিষফোঁড়া’

বছর দু’য়েক আগে সিলেট সিটি করপোরেশন ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি নগরী। বর্তমানে আয়তন বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে ২৭ থেকে হয়েছে ৪২টি। জনসংখ্যা ১০ লাখ। একই সঙ্গে বেড়েছে হকারদের দাপট, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র পার্কিং, বছরজুড়ে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও যানজট। সংকট-অব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকার মতো সিলেট নগরবাসীকেও প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণে যানজট-দুর্ভোগ নিয়ে জাগো নিউজের সিলেট জেলা প্রতিনিধি আহমেদ জামিলের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থটি।

Advertisement

নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনে সড়কের গোল চত্বরে স্থাপনা নির্মাণ করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। বিভিন্ন সড়কের মোড়ে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি স্থাপনা চোখে পড়ে। সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিদায়ের আগ মুহূর্তে এসব চত্বরের নামকরণও করেন। নির্মাণের ১০ বছরের মাথায় সৌন্দর্যবর্ধনকারী এসব স্থাপনাই এখন ট্রাফিকের ‘বিষফোঁড়া’।

বেশিরভাগ চত্বরের স্থাপনাগুলো ‘ট্রাফিক সায়েন্সের’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। এ অবস্থায় এসব চত্বরের স্থাপনা অপসারণ অথবা পুনর্বিন্যাসের জন্য সিটি করপোরেশনকে প্রস্তাবনা দিয়েছে এসএমপি।

সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নগরীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টের গোলচত্বরে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য স্থাপন করা হয় দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে ছিল। নতুন করে বিভিন্ন গোলচত্বরের নামকরণ ও এসব চত্বরে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। গত বছরের ২৬ অক্টোবর আরিফের মেয়াদের শেষ বাজেট উপস্থাপনকালে বিভিন্ন চত্বর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সিলেটের বিভিন্ন গুণী ব্যক্তির নামে নামকরণের বিষয়টি তুলে ধরেন।

Advertisement

বিভিন্ন সময় সড়ক প্রশস্ত হওয়ায় নগরীর হুমায়ুন রশিদ চত্বর, উপশহর রাস্তার মুখ, নাইরপুল, নয়াসড়ক, কোর্টপয়েন্ট, চৌহাট্টা, রিকাবীবাজার, আম্বরখানা, বর্ণমালা পয়েন্টসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টের স্থাপনাগুলো কোনোটি এক পাশে চলে গেছে, কোনোটির কারণে আবার যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।

নগরীর আম্বরখানা পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘সড়ক প্রশস্ত করার কারণে চত্বরে নির্মিত স্থাপনাটি একপাশে চলে গেছে। এতে যানবাহন শৃঙ্খলায় আনতে আরও কষ্ট হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

সড়ক বর্ধিত হলেই দখলে যায় পরিবহন শ্রমিকদের  যানবাহনের চাপ অনুযায়ী প্রশস্ত নয় সড়ক, বাড়ছে জনভোগান্তি  নগরীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বৈধের তিনগুণ অবৈধ যানবাহন

তিনি বলেন, ‘সড়ক এমনভাবে প্রশস্ত করা হয়েছে, একপাশে বেশি একপাশে কম। এখন চত্বরের স্থাপনা নতুন করে পয়েন্টের মাঝখানে পুনর্স্থাপন করতে হবে। তা না হলে এভাবেই যানজটে ভুগতে হবে।’

Advertisement

ট্রাফিকের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ছোট সড়কে প্রতিনিয়ত যানবাহনের চাপ বাড়ছে। তবুও আমরা নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গোলচত্বর নিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’

নগরীর হুমায়ুন রশিদ চত্বরে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইচ্ছামতো সড়ক প্রশস্ত করা হচ্ছে। কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা যারা ট্রাফিকে কাজ করি তাদেরও কোনো পরামর্শ নেওয়া হয় না। এতে অধিকাংশ পয়েন্টের স্থাপনাগুলো ট্রাফিকের কাজের সঙ্গে যায় না। আগামীতে কোনো পয়েন্টে সড়ক বর্ধিত করলে কিংবা স্থাপনা নির্মাণ করলে ট্রাফিক বিভাগের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’

নগরীর বিভিন্ন গোল চত্বরের স্থাপনাগুলো ‘ট্রাফিক সায়েন্সের’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকে এসব স্থাপনা অপসারণ করাসহ নগরীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছে এসএমপি।

১৩ দফা প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে- নগরীর ভেতরে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়মের মধ্যে আনা, নগরীর সোবহানীঘাট সবজি বাজার স্থানান্তর, সড়ক দখল করে বসা হকারদের বিকল্প ব্যবস্থা করা বা উচ্ছেদ করা, নগরীর বিভিন্ন চত্বরের স্থাপনা বা ফোয়ারা অপসারণ বা পুনর্বিন্যাস করা, সিলেট নগরীকে আলোকিত করা, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা অথবা অব্যহৃতগুলো অপসারণ করা, ট্রাফিক পুলিশ বক্স স্থাপন ও কিছু সড়ক ওয়ানওয়ে করা।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরীর বিভিন্ন চত্বরের মধ্যে হুমায়ুন রশিদ চত্বর কোনোভাবেই ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে যায় না। এটা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত একটি চত্বর। এটা ত্রিভুজ আকৃতির। এখানে ট্রাফিককে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা অপসারণ করতে হবে নতুবা পুনর্বিন্যাস করতে হবে।’

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ রাজন দাশ বলেন, ‘ছোট সড়কে বিউটিফিকেশনের নামে অপরিকল্পিত স্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। আগে শহরকে তৈরি করতে হবে। পরে শহরকে সাজাতে হবে। বিশেষ করে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শহরে খোলা জায়গা রাখা।’

তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনামাফিক না এগোলে পাঁচ বছর পরে সিলেট নগরীতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। আর দশ বছর পরে যে অবস্থা হবে, তখন আমাদের কিছু করার থাকবে না। সিটি করপোরেশনে অনেক কাজ হয়েছে কিন্তু পরিকল্পনার অভাব ছিল। এখন থেকে মাস্টার প্ল্যান করেই এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এ স্থপতি।

এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান বলেন, গোল চত্বরের স্থাপনাগুলো অপসারণ করা হবে না। অনেকগুলো অনেক সুন্দর অবস্থায় আছে। তবে, যেগুলো সংস্কার বা পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন সেগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনর্নির্মাণ করা হবে।

জেএএইচ/এএসএ/জিকেএস