বন্ধু সংখ্যা বরাবরই কম আমার। লক্ষ্য করে দেখলাম, দিন যত যাচ্ছে এ সংখ্যা আরও কমে আসছে। তবে কি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে আমার পৃথিবী? এমন এক ভাবনায় রীতিমতো তল থেকে উঠে আসি, তখন খুঁজতে গিয়ে দেখি আমি তো খুব বেশি সামাজিক অনুষ্ঠানে যাই না, গল্প আড্ডা দেই না, কারও বাড়ি গিয়ে থাকি না, হ্যাং ওভার-আউট কিছুই করি না- তাহলে লোকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবেই বা কি করে?
Advertisement
আমি যে খুব ইচ্ছে করে যাই না ব্যাপারটা তাও নয়। আসলে ইচ্ছে হয়, উপায় নেই অনেকটা এমন। আমার খুব ইচ্ছে করে ঘুরতে, বেড়াতে, আড্ডা দিতে, কখনো কখনো বাড়ির বাইরে গিয়ে কোথাও বা কারও বাড়ি থাকতে ইচ্ছে করে না; এমনও নয়।
কিন্তু সত্যি বলতে কি ঝামেলাটা হলো- মানুষ কোথায়? কোথায় গিয়ে কার সাথে আড্ডা দেবো? কার সঙ্গে ঘুরবো? কার সঙ্গে সময় ব্যয় করবো; ঘণ্টার পর ঘণ্টা? কোথায় গিয়ে কার বাড়িতে থাকবো? আসলে থাকাটা বা ঘোরাটা তো বিষয় নয়, বিষয় হলো-বোঝাপড়া।
এই বোঝাপড়ার লোকটি কোথায়? মানুষটি কে? দিন দিন মানুষই তো কমে যাচ্ছে এ শহরে; মুখোশের আড়ালে। ফলে রংচঙ্গা, রাংতা, প্লাস্টিক লোকজনের সঙ্গে আলাপে লাভ কী, বৃথাই সময় ক্ষেপণ ছাড়া? ফলে আমি ন্যূনতম আগ্রহ পাই না এমন সব লোকজনের সঙ্গে গল্প, আড্ডা দিতে বা মিশতে। দু-একবার গিয়েও ছিলাম এমন আড্ডা বা লোকজনের তথাকথিত সামাজিক বলয়ে। কিন্তু সেসব আড্ডায় নিজেকে খুব বেশি মেলাতে পারিনি।
Advertisement
রীতিমতো দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যতক্ষণ ছিলাম কার কয়টা বাড়ি, কার কয়জন উপপত্নী, রক্ষিতা, কারও কারও আবার ‘রক্ষিতা’ কমন পড়ে যাওয়ায় বিকৃত হল্লোর, কে নিজেকে কতটা দলীয় প্রমাণ করতে কোন চতুরতার আশ্রয়ে সফল সেসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিস্তর তামাশা, ঠাট্টা- রীতিমতো বিকারগ্রস্তদের মিলনমেলা বলা চলে।
আমার ভেতরে বিবমিষা; ফলে সেসব জায়গা থেকে পালাতে বাধ্য হই আমি। তার চেয়ে বরং একা থাকা, নিঃসঙ্গ হওয়া, ব্রাত্য হওয়া অনেক ভালো।
তরুণ বয়সের শুরুতেই একটা বড় সময় কেটেছে শওকত আলী, কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, আবুল কাশেম ফজলুল হক, কামাল হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, সিদ্দিকা কবীর, সেলিম আল দীন, ফরহাদ মজহার, বুলবুল ওসমান, সুলতানা কামাল, আমিন আহমেদ চৌধুরী, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, সলিমুল্লাহ খান, রফিক আজাদ- এমন লেখক, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, প্রাজ্ঞ আলোচিত জনদের সান্নিধ্যে। ফলে রুচি নৈতিকতার একটা বোধ ও স্বাদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখনই। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে নিজেও একটা মানদণ্ডে গিয়ে আর নামতে পারিনি। যার কারণে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বই আমার নিয়তি। কিন্তু তাতে কি, এমন সংখ্যালঘু হতে আমার আনন্দ ছিল বরাবরই।
সম্প্রতি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী, সংগীত সাধক, সংগীত শিক্ষাবিদ সাদি মহম্মদের মৃত্যু সংবাদ যে কোনো মানবিক, হৃদয়বান মানুষকে বেদনার তীব্রতায় নিয়ে যাবে। সাদি মহম্মদকে সারাদেশের মানুষ জানেন তিনি কত বড় শিল্পী ছিলেন। নতুন করে তার সম্পর্কে বলার নেই কিছু। তিনি যতটা না বড় শিল্পী তার চেয়ে বড় মানুষ। সজ্জন, নিরহংকার, নির্লোভ, নিভৃতচারী এক শিল্পের সাধক। যিনি তার সারা জীবন ব্যয় করে গেছেন শিল্পের সাধনায়। তার আত্মহত্যায় মৃত্যু অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিল্পীদের অনেকেই তাকে নিয়ে লিখেছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
Advertisement
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার লিখেছেন- পুরস্কার দেয় নাই। এ অভিযোগ ঢাকার জন্য এখন শুরু হয়েছে উনি এটার ঊর্ধ্বে ছিলেন এই বাণী প্রদান। উনি যে কষ্ট পেয়েছিলেন সেটা তার আপন ছোট ভাই বলেছে। আর আপনারা তালতো ভাইরা এসে শুরু করেছেন বলতে শিল্পীর পদক লাগে না- মূল্যায়ন লাগে না। শিল্পী মহান।
তাহলে পদকগুলো যাদের দেয় তারা কারা? তারা শিল্পী না? তাহলে তারা সবাই পদকের নিম্নে আর সাদি ভাই খালি উপরে?
উনি আত্মহত্যা করলেন। বিষণ্নতায় ডুবে গেলেন। বিষণ্নতার বাকি সব কারণ মেনে নিলেও শুধু পদকজনিত বিষণ্নতা মানতে আপনারা রাজি না। উনি বিষণ্ন কিন্তু এটার কারণ পদক নয়।
শিল্পী পদকের জন্যও গায় না। শিল্পী গায় নিজের আনন্দে। এগুলো যারা বলছে তাদের বেশিরভাগ কিন্তু একটা কাশি দিলেও পয়সা-পুরস্কার দুটোই চায়।
তাদের মত অনুযায়ী তাহলে শিল্পী আলু-পটোলের দাম বাড়লে বিষণ্ন হতে পারবে কিন্তু পুরস্কার না পেলে বিষণ্ন হতে পারবে না?
ফোঁপড়দালালির একটা সীমা আছে।
দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া আরেক শিল্পী প্রীতম আহমেদ লিখেছেন, ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অনেক শিল্পীই আত্মহত্যা করবে। নীরবে অসম্মান ও অতৃপ্তি নিয়ে কজনইবা বাঁচতে পারে বলুন? এই মরদেহগুলো নীরব অভিমানী শিল্পীর পক্ষ থেকে ইতর, নির্লজ্জ মিডিয়াবাজ ও অথর্ব রাষ্ট্রীয় সিস্টেম উপহার।
সাদি মহম্মদ ঝাঁকের কই নয়, ফলে ঝাঁপিয়ে পড়া লোকজনের বলয়ে তাকে কখনোই দেখা যায়নি। লোকজনকে ‘মেনটেইন’ করার ব্যাপারটা তার মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। মুক্তিযোদ্ধা বাবার নৃশংস মৃত্যু নিজে দেখেছেন, কিন্তু চেতনার দোকান দেন নাই। জয় বাংলা বেচা-কেনার পসরা বসাননি। দারুণ রুচিবান একজন মানুষ ছিলেন বলেই হয়তো দিন দিন আরও একা হয়েছেন।
একটা অসভ্য, দালাল, দলাদলি আর সাপ্লাইয়ের সমাজে যে কোনো ভদ্রলোক দিন দিন একা হবেন, সুজন-স্বজনহীন হবেন, বন্ধুহীন হবেন এটা খুব স্বাভাবিক। আমার মতো ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, তৃণ লেখকই যদি সবার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পারি, তাহলে সাদি মহম্মদের মতো মানুষের পক্ষে তো তা আরও অসম্ভব। ‘ওল্ড ম্যান ইন দ্যা সি’ খ্যাত আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে অনেক লিখেছেন। কিন্তু সেই হেমিংওয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু হেমিংওয়ে সৌভাগ্যবান, তিনি সহানুভূতি সম্পন্ন সমাজে জন্মেছিলেন, ফলে তার আত্মহত্যার পর সবাই তার সংগোপন বেদনা অনুভব করতে পেরেছিলেন।
এমন মহৎ মহান একজন শিল্পী কেন আত্মহননে প্রবৃত্ত হয় তা বোঝার সক্ষমতা এ সমাজ ও রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্র আছে তার ভবন, সেতু নিয়ে কিন্তু মানবিকতা কোথাও চাপা পড়ে শ্বাসরোধের উপক্রম কি না তা দেখবে কে?
এই রাষ্ট্র, সমাজ যে শিল্প ও শিল্পীর জন্য নয় তা সাদির মতো অনেকেই বুঝে গেছেন। ফলে অনেকেই ঠিকানা খুঁজে নিতে গেছেন অন্য শহরে, অন্য দেশে। কিন্তু সত্যিকার দেশপ্রেমিক বাবার সন্তান সাদি মহম্মদ কখনই এমন চিন্তায় যান নাই।
প্রাপ্ত সম্মান আর মর্যাদার প্রশ্নে নিজেই হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদ।
লেখক: সদস্য ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র, সম্পাদক, আজ সারাবেলা।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম