বছর দু’য়েক আগে সিলেট সিটি করপোরেশন ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি নগরী। বর্তমানে আয়তন বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে ২৭ থেকে হয়েছে ৪২টি। জনসংখ্যা ১০ লাখ। একই সঙ্গে বেড়েছে হকারদের দাপট, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র পার্কিং, বছরজুড়ে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও যানজট। সংকট-অব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকার মতো সিলেট নগরবাসীকেও প্রতিদিনই বাসায় ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণে যানজট-দুর্ভোগ নিয়ে জাগো নিউজের সিলেট জেলা প্রতিনিধি আহমেদ জামিলের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয়টি।
Advertisement
সিলেট নগরী আয়তনে বাড়লেও সে তুলনায় প্রশস্ত হয়নি সড়ক। যেগুলো প্রশস্ত করা হচ্ছে সেগুলো কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের দখলে। সেই দখলদারত্ব থেকে কোনোভাবেই এসব সড়ক উদ্ধার করতে পারছে না সিলেট সিটি করপোরেশন। উদ্ধারে অভিযান চালালে উল্টো অবরোধ-ধর্মঘট করে সিলেটকে অচল করে দেন তারা। যে কারণে সড়ক প্রশস্তকরণের কোনো সুফল পাচ্ছে না জনগণ।
সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ৩৭৫ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করা হলেও তার নিয়ন্ত্রণ নেই খোদ সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক)। অন্তত দেড় শতাধিক স্থানে অবৈধ স্ট্যান্ড বসিয়ে সড়ক দখল করে রেখেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। কোথাও সড়কের অর্ধেক অংশজুড়েই পার্কিং স্ট্যান্ড। অনেকেই এসব স্ট্যান্ডে পরিবহন সংগঠনের নামসর্বস্ব সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে রেখেছেন। এতে সড়ক প্রশস্ত হলেও দুর্ভোগ কমেনি। উল্টো পরিবহন শ্রমিকদের রাজত্ব বেড়েই চলছে।
এটা সত্য। শ্রমিকরা সব সময় একটু বড় জায়গা চায়। বসতে বসতে একসময় স্ট্যান্ড বানিয়ে নেয়। এটা নিয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মেয়র বলেছেন সুন্দর করে বসার একটা স্থান দেবেন। শিগগির সিদ্ধান্ত হবে।- জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকারিয়া আহমদ
Advertisement
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, নগরীতে ৫৭টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার পার্কিং স্ট্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এলাকায় অনুমোদন রয়েছে একটি স্ট্যান্ডের। সেখানে ১০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা রাখার অনুমোদন দিয়েছে সিসিক। আর কোনো পার্কিংয়ের অনুমোদন নেই।
এসএমপির এ তথ্যের বাইরে সিলেট নগরীতে শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ডের তথ্য পাওয়া যায়। আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে হাসপাতালকেন্দ্রিক স্ট্যান্ড রয়েছে অটোরিকশার। এসব কোনোটিরই অনুমোদন নেই। এসব স্ট্যান্ডে থাকা অটোরিকশা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। হাসপাতালকেন্দ্রিক স্ট্যান্ডগুলোতে মানুষকে জিম্মি করে ভাড়া আদায় করছেন চালকরা। এতে যানজটের দুর্ভোগ ছাড়াও ভাড়া নিয়ে অতিষ্ঠ সাধারণ যাত্রীরা।
এসব পার্কিং স্ট্যান্ড নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন ও পরিবহন শ্রমিকরা। পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, সব কটি পার্কিং স্ট্যান্ডের অনুমোদন দিয়েছে সিটি করপোরেশন। তবে অনুমোদনের কোনো কাগজপত্র নেই তাদের হাতে। সিলেট সিটি করপোরেশন বলছে, তারা কোনো পার্কিং স্ট্যান্ডের অনুমোদন দেয়নি।
সিলেট মেট্রোপলিটন গঠিত হওয়ার পর থেকে নগরীর গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনসহ সব ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং নীতি নির্ধারণে মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি (এমআরটিসি) নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর অনুমোদন দেয় বিআরটিসি। কাগজে-কলমে এ কমিটি থাকলেও এর কার্যক্রম খুব একটা নেই। পরবর্তীসময়ে এ কমিটিতে আরও পরিবর্তন এনে মেট্রোপলিটন প্যাসেঞ্জার্স অ্যান্ড গুড ট্রান্সপোর্ট কমিটি (এমপিজিটিসি) নামকরণ করা হয়।
Advertisement
১২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে চেয়ারম্যান ও বিআরটিএর সহকারী পরিচালককে সদস্য সচিব করা হয়। এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয় এসএমপির উপ-কমিশনার (ট্রাফিক), বিভাগীয় কমিশনারের একজন প্রতিনিধি, পরিবহন সেক্টরের একজন প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি। কাগজে-কলমে এ কমিটি নগরীর যান চলাচল ও পণ্য পরিবহনে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ হলেও এর কর্মকাণ্ড খুব একটা চোখে পড়েনি।
আরও পড়ুন
নগরীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বৈধের তিনগুণ অবৈধ যানবাহন যানবাহনের চাপ অনুযায়ী প্রশস্ত নয় সড়ক, বাড়ছে জনভোগান্তি স্বস্তিতে পণ্য কিনতে সিলেটে চালু হলো ন্যায্যমূল্যের দোকানপরিবহন চালকদের নৈরাজ্য ঠেকাতে নতুন করে কোনো নীতিমালার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে নীতিমালার অভাব নেই। নীতিমালা বাস্তবায়নের অনেক অভাব রয়েছে। নগরীর পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব নীতিমালা আছে সেগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও কঠোর হতে হবে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট নগরজুড়ে রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্ট্যান্ড। নগরের কোর্ট পয়েন্ট, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট, চৌহাট্টা-আম্বরখানা সড়ক, চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার সড়ক, আম্বরখানা-বিমানবন্দর সড়ক দখল করে এসব স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে।
এর মধ্যে চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার সড়কের দুই পাশে ও চৌহাট্টা থেকে আম্বরখানা সড়কের একপাশে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা দখল করে অস্থায়ী মাইক্রোস্ট্যান্ড বসিয়েছেন চালকরা। ফলে প্রতিদিন এ দুটি সড়কে যাতায়াতকারীরা যানজটের শিকার হচ্ছেন। ২০২০ সালে চৌহাট্টা-আম্বরখানা সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে গেলে তোপের মুখে পড়েন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে অরাজকতার সৃষ্টি করেন। পরে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
এছাড়া নগরীর আম্বরখানা, সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেট, ওসমানী মেডিকেল, রিকাবীবাজার, জিতু মিয়ার পয়েন্ট, কোর্টপয়েন্ট, উপশহর রাস্তারমুখ, টিলাগড় ও বালুচরসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে শতাধিক স্ট্যান্ড বসিয়েছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা শ্রমিকরা।
চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার ও আম্বরখানামুখী দুটি সড়কে অন্তত তিনশ-চারশ মাইক্রোবাস ও অন্য গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। আম্বরখানামুখী সড়ক থেকে বেশিরভাগ গাড়ি ভাড়ায় জেলা শহর সুনামগঞ্জ ছাড়াও ছাতক ও দিরাই উপজেলায় যায়। চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার সড়ক থেকে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় যায় এসব গাড়ি।
একাধিক মাইক্রোবাসচালক জানান, নগরে মাইক্রোবাস রাখার জন্য নির্ধারিত কোনো স্ট্যান্ড নেই। তাই তারা এই দুটি সড়ককে অস্থায়ী স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করছেন। এখানে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচশ গাড়ি থাকে। এসব গাড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় চলাচল করে।
নগরীর কোথাও বৈধ পার্কিং নেই। এছাড়া বড় বড় মার্কেট, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পার্কিং নেই। যার প্রভাব পড়ছে সড়কে। তাছাড়া শহরে এই মুহূর্তে সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এগুলোর বেশিরভাগ অনিবন্ধিত। সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব যানবাহন একটা নিয়মের মধ্যে আনতে আমরা কাজ করছি।- সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান
সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকারিয়া আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরীর কোথাও পার্কিং স্ট্যান্ডের কোনো লিখিত অনুমোদন নেই। কেউ লিখিত অনুমোদন দেয় না। মৌখিক অনুমোদন দিয়েছে সিটি করপোরেশন। মৌখিক অনুমোদনে বলা হয়েছে, পয়েন্টগুলোতে এক লাইনের বেশি গাড়ি রাখা যাবে না। এছাড়া ১৫-২০টির বেশিও রাখা যাবে না।’
হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকার মোড়ে মোড়ে পার্কিং স্ট্যান্ড প্রসঙ্গে পরিবহন নেতা জাকারিয়া বলেন, ‘এগুলোর অনুমোদন সরকারও দেয়নি, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও দেওয়া হয়নি। এগুলো স্বঘোষিত স্ট্যান্ড। এসব স্ট্যান্ডে আমাদের সংগঠনের কোনো কর্মকাণ্ড চলে না। যে স্ট্যান্ডগুলো আমাদের অনুমোদিত সেখানে আমাদের লোকজন থাকে, ম্যানেজার থাকে।’
প্রশস্ত হওয়া সড়ক দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য। শ্রমিকরা সব সময় একটু বড় জায়গা চায়। বসতে বসতে একসময় স্ট্যান্ড বানিয়ে নেয়। এটা নিয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মেয়র বলেছেন সুন্দর করে বসার একটা স্থান দেবেন। শিগগির সিদ্ধান্ত হবে।’
এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. দিলু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘যত্রতত্র পার্কিং স্ট্যান্ড নিয়ে আমরাও অতিষ্ঠ। রাস্তায় রাস্তায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড। বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়টি আমাদের অবগত করা হয়। এ ব্যাপারে মেয়র বলেছেন সবাইকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে। আগামী মাসে এ নিয়ে বৈঠক হবে। বৈঠকে পরিবহন শ্রমিকরা কোথায় পার্কিং স্ট্যান্ড করবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগরীর কোথাও বৈধ পার্কিং নেই। এছাড়া বড় বড় মার্কেট, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পার্কিং নেই। যার প্রভাব পড়ছে সড়কে। তাছাড়া শহরে এই মুহূর্তে সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এগুলোর বেশিরভাগ অনিবন্ধিত। সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব যানবাহন একটা নিয়মের মধ্যে আনতে আমরা কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘সিলেট নগরীতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নীতিনির্ধারণে একটি কমিটি রয়েছে। ২০২৩ সালে এ কমিটি অনুমোদন দিয়েছে বিআরটিএ। এ কমিটির বেশ কয়েকটি সভা হয়েছে। মার্চ মাসেও কমিটির সভা হবে। এসব বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হবে।’
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘সিএনজিচালিত অটোরিকশা শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের কীভাবে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। একটা একটা করে সব সমস্যার সমাধান হবে।’
জেএএইচ/এএসএ/জিকেএস