মতামত

জাতীয় স্বার্থ কেন গুরুত্ব পায় না এমন সম্মানিত ব্যক্তির কাছে?

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন সিনেটর ডারবিন। বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর প্রতিহিংসা বন্ধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমি মি. ইমরানের সঙ্গে বৈঠকের পর ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছি।’

Advertisement

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর এটা কি প্রকাশ্য হুমকি নয়?

একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর জন্য বাংলাদেশের আইনের সম্ভাব্য বড় ধরনের অপব্যবহার হতে পারে।’

বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ যাদের কাছে গুরুত্ব পায়, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড় যাদের কাছে তারা বলবেন- সরকার কিংবা অন্য কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে এমনকি তিক্ততা থাকলেও তার কারণে যেন প্রিয় স্বদেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ডারবিন বলছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা বন্ধ না করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

Advertisement

বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বলতে পারতেন-আমার সমস্যা সরকারের সঙ্গে, কিন্তু এ কারণে বাংলাদেশের পোশাক আমদানি কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশের ওপর কোনো ধরনের অন্যায় নিষেধাজ্ঞা কিংবা অবরোধ আরোপ বা তার হুমকি দেওয়ার বিরুদ্ধেও তিনি অবস্থান নিতে পারতেন।

কিছুদিন আগে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৫৪ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন। গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টকে আয়কর সংক্রান্ত মামলায় আপিল করার জন্য এই অর্থ জমা দিতে বলা হয়েছিল। তাঁর কাছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা আয়কর দাবি করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তিনি ২০২৩ সালেও একটি রায়ের কারণে ১২ কোটি টাকা কর পরিশোধ করেছেন।

৭ মার্চ হাইকোর্টের আরেক নির্দেশে বলা হয়, ২০১১ থেকে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য ১১৯ কোটি টাকা কর পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

এত বিপুল অর্থ তিনি কিন্তু ধার না করেই পরিশোধ করেছেন। স্পষ্টতই তার কিংবা তার প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ ছিল, কিন্তু সরকারের পাওনা পরিশোধে ছিল আপত্তি বা অনীহা।

Advertisement

ইউনূস সেন্টার বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এই নোবেল বিজয়ীর অর্থ নিয়ে গণমাধ্যমে যে আলোচনা চলছে, তার পুরোটাই প্রফেসর ইউনূসের অর্জিত টাকা। এর পুরোটাই বিদেশে অর্জিত এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনা হয়েছে। সব টাকার হিসাবে আয়কর রিটার্নে উল্লেখ থাকে। তিনি জীবনে কোনো সম্পদের মালিক হতে চাননি, বরং মালিকানা মুক্ত থাকতে চান। কোথাও তার মালিকানায় বাড়ি, গাড়ি, জমি, শেয়ার নেই। তিনি উপার্জনের টাকা দিয়ে দুটি ট্রাস্ট গঠন করেছেন।

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক-কর কর্তৃপক্ষের হয়রানি নিয়ে সব দেশেই কমবেশি অভিযোগ থাকে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। আবার কর ফাঁকির ঘটনাও বিস্তর। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে সরকারি কৌশলী বলেছেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির বিষয়ে জানতেন।

উগ্র ধরনের মন্তব্যের জন্য সুপরিচিত এই সাবেক প্রেসিডেন্ট রাখঢাকা না করেই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন- কর ফাঁকির সুযোগ রয়েছে আইনে, আমি কেন সেটা নেব না?

ড. ইউনূস সাম্প্রতিক একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- গ্রামীণ ব্যাংকে যুক্ত নারীদের বেশিরভাগ এমনকি নাম লিখতে পারত না। আমরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। নাম লেখা শেখার পর তাদের যে আত্মবিশ্বাস সেটা ছিল দেখার মতো। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে অন্তত এক কোটি লোক সংশ্লিষ্ট- এভাবেই বলা হতো। এর অর্থ হচ্ছে অন্তত ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ এ ব্যাংকের সুবিধার আওতাভুক্ত। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তার ‘কিছু কথা কিছু স্মৃতি’ বইয়ে লিখেছেন, ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিটের ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের আর্থিক অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, এ কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। দু’হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে এবং শতকরা আঠাশ শতাংশ পর্যন্ত বা তারও বেশি সুদ দিয়ে কোনো লোকের পক্ষে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব নয়।... গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চ হারে সুদের হারে ঋণ দেওয়াকে আমি কখনও সমর্থন করিনি।’ [কিছু কথা কিছু স্মৃতি, পৃষ্ঠা ২০০]

১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয় বাংলাদেশে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং আরও কয়েকটি এনজিও-এর লাখ লাখ ঋণ গ্রহীতারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিলেন না। দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা এক মাসের বেশি পানির নিচে থাকায় ফসল ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল বন্যায়। এই কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকে বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন। গ্রামীণ ফোন চালুর সময়েও শেখ হাসিনা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূস যুক্তভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন শান্তিতে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে একজন নারী ড. ইউনূসের পাশে থেকে এ সম্মানের পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। কেউ কি ওই নারীকে পরবর্তী সময়ে দেখেছেন? নারীর ক্ষমতায়ন প্রদর্শনের জন্য আমরা অনেক অনেকবার দেখেছি গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভায় ‘হতদরিদ্র’ নারীদের উপস্থিতি। এখন কোথায় তারা?

ড. ইউনূস এবং তাঁর মেয়ে বলেছেন, সরকার চাইলে সহযোগিতা করবেন এই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ। শেখ হাসিনা মুখে নয়, কাজেই সহযোগিতা করেছেন ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠানকে। তার তো প্রতিদান দেওয়ার কথা। কিন্তু যথাযথ প্রতিদান মিলেছে কি? যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর বলেছেন প্রতিহিংসার কথা। আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও বক্তব্য দিচ্ছেন একই অভিযোগ এনে। বাস্তবে প্রতিহিংসা কোন তরফে? বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে নানাভাবে হেয় করেই প্রতিদান দেওয়া হচ্ছে? বাংলাদেশের ওপর এমবার্গো আরোপ বা ক্রমাগত তার হুমকি যাচ্ছে তাদেও সম্পর্কে চুপচাপ থাকা কিংবা এমনকি এজন্য প্ররোচনা দিয়েই কি প্রতিদান দেওয়া হচ্ছে? বাংলায় প্রবাদ আছে-‘উপকারীকে বাঘে খায়’। এ ক্ষেত্রে কি তেমনটিই ঘটছে? বাঘকে যে ব্যক্তি শিকারির জাল থেকে মুক্ত করেছিল, তাকেই খেয়ে নেয় হিংস্র বাঘ। ড. ইউনূস নিশ্চয়ই এ প্রবাদের অর্থ উপলব্ধি করতে পারেন।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস