জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সাদাফ অবন্তিকাকে প্রথম বর্ষে পড়াকালীন প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলেন সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকে আম্মান তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। ক্যাম্পাস চত্বরে, ক্লাসে, করিডোরে এবং বিভিন্ন স্থানে তিনি উত্ত্যক্ত করতেন।
Advertisement
গত বছরের (২০২৩ সালের) ১৪ নভেম্বর আইন বিভাগের চেয়ারম্যান আলী আক্কাসের মাধ্যমে তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল বরাবর একটি অভিযোগ দেন অবন্তিকা। ওই অভিযোগপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগপত্রে অবন্তিকা লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন আমার ব্যাচের আমারই বিভাগের আম্মান সিদ্দিকী আমার সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণ ও উত্ত্যক্ত করে আসছে। প্রথম বর্ষে প্রেমের প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যান করলে সে ব্যক্তিগত জীবনে এগিয়ে যায়। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাকে দেখে সে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল মন্তব্য করে এবং আমি ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় বিপত্তি বাঁধে। সে অপমানিতবোধ করে এবং আমাকে বলে, আমার একদিন এমন অবস্থা করবে বা এমনভাবে ফাঁসাবে যাতে আমি মেয়ে হয়ে সমাজে মুখ দেখাতে না পারি এবং সুইসাইডে বাধ্য হই।’
অবন্তিকা আরও লেখেন, ‘এমন আগ্রাসী আচরণ, গালাগাল, রাস্তায় গেলে দুর্ঘটনার হুমকিতে রূপ নেয়। তখন আমার বাবা অসুস্থ থাকায় আমি এ বিষয়ে গুরুত্ব দেইনি। পরে আমি তাকে স্পষ্ট করে বলে দেই আমার সঙ্গে যেন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যোগাযোগ না রাখে।’
Advertisement
অভিযোগে অবন্তিকা আরও বলেন, ‘এরপর কিছুদিন বন্ধ থাকে। হঠাৎ ছেলেটি মেসেঞ্জারে আমাকে বলে, সে এমন কিছু তথ্য ছড়াবে মানুষের কাছে যাতে আমি অপদস্থ হই এবং সে কবর থেকে একদম মুর্দা তুলে ফেলবে ওর সঙ্গে কিছু করলে! সম্প্রতি আমার বাবা মারা গেলে তার হুমকি–ধামকি এবং উৎপাতের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় আমি ডিপার্টমেন্টের করিডোরে একা থাকলে সে আমাকে বিবিএ ফ্যাকাল্টির ছাদে কিংবা সম্পূর্ণ ফাঁকা ক্লাসরুমে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ডাকে। আমি সরাসরি কথা বললে রেকর্ড করবো এই ভয়ে সে (আম্মান) সেখান থেকে দ্রুত চলে যায়। কয়েক মাস আগে সে আমাকে আবারও ডাকে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের ওপরের ফ্লোরে নিয়ে কথা বলতে চাইলে আমি প্রতিবাদ করি। সে আমাকে তখন ভয় দেখায় এই বলে যে, আমার নামে প্রক্টর স্যারের কাছে নালিশ দিবি? দে, দেখি কী করতে পারিস। প্রক্টর স্যারকে একটা কল দিলেই স্যার ধরেন, কারণ আমি সাংবাদিক। তুই জানিস, কোতোয়ালি থানাতেও আমার কেমন লিংক। এক সেকেন্ড লাগবে তোকে ফাঁসাতে। সেদিন আমি ভয়ে হোমটাউন চলে যায়। কিন্তু এরপর পরীক্ষা দিতে আবার আসতে হয়।’
আরও পড়ুন
একপাক্ষিক দোষী না ভেবে পুরো বিষয় জানার আহ্বান অভিযুক্ত সহপাঠীর অবন্তিকার আত্মহত্যা: শিক্ষক দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান আটক অভিযুক্তদের গ্রেফতারে ১২ ঘণ্টার আলটিমেটামঅভিযোগে অবন্তিকা লিখেছেন, ‘যখনই আমার বন্ধু–বান্ধবেরা আমার থেকে চলে যেত, তখনই সে আমাকে সেদিন একা পেয়ে বিকেল ৩টা ২৬ মিনিটে আবার ফাঁকা ক্লাসরুমে ডাকে। তখন আমি ইগনোর করে যেতে চাইলে সে আমার পথ আটকায় এবং তার ডাকে ক্লাসরুমে না যাওয়ায় ধমক দেয়। আমি ঠিক তখনই তাকে বিভাগের অফিস রুমে নিয়ে যাই, যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়। আমি প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত, এমনকি পরিবার ছাড়া ঢাকায় থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচলেও অনিরাপদবোধ করি।’
গত বছরের এসব অভিযোগ সম্পর্কে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবন্তিকা যখন প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দেয় তখন আমি তাকে বলছি অফিসে এসে সরাসরি কথা বলতে। তাদের এই ঘটনা নিয়ে অতীতে তদন্ত কমিটিও ছিল। আবার ওই সময় আবার ভিসি স্যার মারা যাওয়ায় আর এসব বিষয়ে শুনতে পারিনি। অবন্তিকা আর অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসেনি।’
Advertisement
এ বিষয়ে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়টাতে প্রথম থেকে এই মেয়েটার সঙ্গে যা হয়েছে সে কখনোই বিভাগকে জানায়নি। সব অভিযোগ ছিল প্রক্টর অফিসকেন্দ্রিক। শুধু প্রথমে এই ছেলেদের সঙ্গে ঝামেলাকে কেন্দ্র করে তার মা-বাবাকে প্রক্টর অফিস ডেকেছে, তখন জানি সে বিষয়টার সমাধানও হয়ে গেছে। এরপর গত নভেম্বরে হঠাৎ মেয়েটি আমাকে এসে বলে, স্যার আগের ঘটনা মীমাংসা হয়েছে, কিন্ত ওরা এখনো আমাকে এখনো ডিস্টার্ব করছে। আমি প্রক্টর বরাবর দরখাস্ত দেবো। তখন আমি তার দরখাস্তে সুপারিশ করে দেই।’
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অবন্তিকার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করিনি। এমনকি ফেসবুক, মেসেঞ্জার বা কোনো জায়গাতেই কানেকটেড না আমি। আমাকে দোষী প্রমাণের জন্য এভিডেন্স লাগবে। এভিডেন্স ছাড়া এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
ফেসবুকে ‘এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার’ স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন সাদাফ অবন্তিকা। ওই ফেসবুক পোস্টে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে দায়ী করেন তিনি।
আরএএস/কেএসআর/জেআইএম