‘অ্যান্ড লিটন দাস ইজ পেইন্টিং এ মোনালিসা হিয়ার!’ তার ব্যাটিং দেখে ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ইয়ান বিশপ ঠিক এমন মন্তব্যই করেছিলেন। ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টিকর্ম মোনালিসা। লিটনের ব্যাটিংয়ে যেন সেই শৈল্পিকতার ছোঁয়াই দেখেছিলেন বিশপ!
Advertisement
বিশপের এমন প্রশংসা বাড়াবাড়ি নয় মোটেই। লিটন যেদিন ফর্মে থাকেন, সেদিন তো ব্যাটটাকে শিল্পীর তুলি বানিয়ে ২২ গজে দারুণ ক্যানভাসই আঁকেন। দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং, নান্দনিক স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে এনে দেন চোখের প্রশান্তি।
কিন্তু যার ব্যাটিং এমন মুগ্ধতা ছড়ায়, সেই লিটন নিজের প্রতিভার প্রতি কতটা সুবিচার করতে পেরেছেন? আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রায় ৯ বছর কাটিয়ে ফেলার পর লিটন নিজেও নিশ্চয়ই সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
বয়স প্রায় ৩০ ছুঁইছুঁই। এখন আর নিজেকে ‘ইয়ংস্টার’ পরিচয় দেওয়ার সুযোগ নেই। লিটন দাসের ব্যাট এখন দলের বড় ভরসা হয়ে উঠার কথা ছিল, সেটা কি হতে পেরেছে? এককথায় উত্তর-‘না’।
Advertisement
আসুন এক নজরে পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে লিটনের পরিসংখ্যান খুব খারাপ না। আবার খুব আহামরি কিংবা বিশ্বমানেরও না মোটেই।
৩৯ টেস্টে ৩টি সেঞ্চুরিসহ ২৩৯৪ রান, গড় ৩৬.২৭। ৭৭ টি-টোয়েন্টিতে ১০ ফিফটিসহ ১৭৫৪ রান। গড় ২৩.৭০, স্ট্রাইকরেট ১২৯.৯২। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উৎড়ে যাওয়ার মতো।
তবে লিটনের ওয়ানডে ফরম্যাটের পরিসংখ্যান, রীতিমত হতাশার ছবিই আঁকবে। এই জায়গায় লিটনকে ‘ওভাররেটেড’ই বলা যায়। ৯১ ওয়ানডেতে ৫টি সেঞ্চুরিসহ লিটন করেছেন ২৫৬৩ রান। গড় ৩১.২৫।
যে সৌম্য সরকারকে অফফর্মের কারণে ওয়ানডে দলে নিয়মিত রাখা হয় না, তার গড়ও লিটনের থেকে ভালো (৩৩.৫৩)। এমনকি ওয়ানডে গড় লিটনের থেকে ভালো ইমরুল কায়েসেরও (৩২.০২)। অথচ লিটনকে এই দুজনের থেকে প্রতিভার দিক থেকে অনেক বেশি ওপরে ভাবা হয়।
Advertisement
ওয়ানডেতে লিটনের ক্যারিয়ারের শুরুটাই ভালো ছিল না। প্রথম ১৭ ইনিংসে ফিফটিরও দেখা পাননি। এর মধ্যে ১০ ইনিংসেই রান ছিল দশের নিচে। তারপরও লিটনের প্রতিভার ওপর ভরসা রেখেছেন নির্বাচকরা।
অবশেষে লিটন আস্থার প্রতিদান দেন ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। দুবাইয়ে ২০১৮ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে ১১৭ বলে ১২১ রানের ইনিংস খেলে সবার নজরে আসেন লিটন। অনেকেই ভেবেছিলেন, এরপর হয়তো আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
কিন্তু এমন এক ইনিংস খেলার পরও লিটনের ব্যাটে ধারাবাহিকতার অভাব ছিল স্পষ্ট। পরের নয় ইনিংসের মধ্যে ছয়বারই দশের নিচে আউট। মাঝে মোটামুটি রানে থাকলেও বড় দলের বিপক্ষে লিটনের ব্যাট হেসেছে কালেভদ্রে।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৫টি সেঞ্চুরি। প্রথমটি শুরু করেছিলেন ভারতকে দিয়ে, এরপর আর কোনো বড় দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি পাননি লিটন। বাকি ৪ সেঞ্চুরির তিনটিই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, একটিতে প্রতিপক্ষ ছিল আফগানিস্তান।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওই সেঞ্চুরিটিও করেছিলেন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর গত দুই বছরেরও বেশি সময় লিটনের ব্যাট থেকে কোনো সেঞ্চুরি আসেনি। সবশেষ দশ ইনিংসে করতে পারেননি ফিফটিও।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চলতি ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে করেছেন শূন্য, এর মধ্যে একটি আবার গোল্ডেন ডাক। সবমিলিয়ে লিটন এই ফরম্যাটে একদমই ছন্নছাড়া। ৯১ ওয়ানডে খেলে ফেললেও ওয়ানডে ফরম্যাটে কখনই নিজেকে বড়মানের ব্যাটার হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি লিটন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিটন হয়তো উৎড়ে যাবেন টেস্ট আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। তবে বিশ্বমানের কথা বিবেচনায় আনলে লিটন কোনো ফরম্যাটেই সেই মানে যেতে পারেননি।
বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক আঙিনায় নয় বছর কাটিয়ে ফেললেও লিটন নিজের দেশেরই সেরা ব্যাটার হয়ে উঠতে পারেননি, বিশ্বমান তো আরও পরে। অথচ এই লিটনের মধ্যে যে প্রতিভা ছিল; শুরুতে অনেকেই ভেবেছিলেন, এই ছেলেটি হয়তো একদিন কোহলি-বাবর আজমদের কাতারে নিজের নাম লেখাবে!
এমএমআর/জেআইএম