একুশে বইমেলা

বীরের মুখে বীরত্বগাথা: দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে

‘বীরের মুখে বীরত্বগাথা’ শিরোনামে বইটি মূলত সশস্ত্র বাহিনীর পঁচিশ বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার। মূল্যবান বইটি সম্পাদনা করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ও ‘নগদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা তানভীর এ মিশুক। নগদ ও ইত্তেফাকের যৌথ উদ্যোগে বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য। উৎসর্গ করা হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তা ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

Advertisement

বইয়ের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ‘আমাদের এই সংকলনের উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্মকে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধের বিশালতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেই সাথে এটিও জানানো যে, এই দেশটি কারো দানে নয়; বরং কী অসম্ভব ত্যাগের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির জন্ম হয়েছে। এটি উপলব্ধি করানোই আমাদের লক্ষ্য। এই ২৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনে একটি নতুন প্রাণও যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহী হয়, তাহলেই আমাদের সব প্রচেষ্টা সার্থক হবে।’ (মুখবন্ধ, তানভীর এ মিশুক)

এই বইয়ের সাক্ষাৎকারগুলো ২০২২ সালের মার্চ মাসে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ২৫ বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে সেগুলো লিখিত রূপ দিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার সমীর কুমার দে। ‘বীরের মুখে বীরত্বগাথা’ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সঞ্জয় বিশ্বাস ও ফয়সাল আলম শান্ত।

বইতে যাঁদের সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাঁরা হলেন—স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম বীরউত্তম (অবসরপ্রাপ্ত), লে. কর্নেল নিরঞ্জন ভট্টাচার্য্য (অব.), ক্যাপ্টেন মো. ইসহাক (অব.), লে. কমান্ডার মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন বীরউত্তম (অব.), মেজর জেনারেল জামিল উদ্দিন আহসান (জামিল ডি আহসান) বীরপ্রতীক (অব.), লে. কর্নেল আবদুর রউফ বীরবিক্রম (অব.), মেজর অলিক কুমার গুপ্ত বীরপ্রতীক (অব.), লে. কর্নেল আবদুল মান্নান বীরবিক্রম (অব.), মেজর তাহের উদ্দিন আখনজি (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বীরবিক্রম (অব.), মেজর মো. ওয়ালিউল ইসলাম বীরপ্রতীক (অব.), মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস (অব.), কর্নেল মো. আমিন উল ইসলাম (অব.), কর্নেল মো. শাহ জাহান মোল্লা (অব.), কর্নেল মো. আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক (অব.), ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীরউত্তম (অব.) প্রাক্তন পিআইএ পাইলট, কাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বীরপ্রতীক (অব.) প্রাক্তন পিআইএ পাইলট, মেজর জেনারেল মাসুদুর রহমান বীরপ্রতীক (অব.), লে. কর্নেল মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বীরপ্রতীক (অব.), মেজর এ টি এম হামিদুল হোসেন বীরবিক্রম (অব.), গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীরউত্তম (অব.), মেজর ওয়াকার হাসান বীরপ্রতীক (অব.), লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জাহির বীরপ্রতীক (অব.), কমোডর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীরউত্তম, বীরবিক্রম (অব.), মেজর মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম (অব.)।

Advertisement

প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া কাহিনি বর্ণনা করেছেন। যা শুনে কখনো শরীর শিউরে ওঠে। কখনোবা গা ছমছম করে ওঠে। সেসব অভিযানের গল্প বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে আগ্রহী করে তুলবে। শুরুতেই স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম বীরউত্তম (অবসরপ্রাপ্ত) বলেছেন, ‘আমি যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাবা রাজি ছিলেন। ‘মা’ও খুব বেশি বাধা দেননি। অন্যদের সঙ্গে আমিও লঞ্চে উঠলাম। আমরা পাঁচ জন ছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর পাকিস্তানি আর্মিদের মুখোমুখি হই। সামান্য ঝামেলার পর একটা ফার্ম হাউসের ঘাটে আমরা নেমে গেলাম। ঐ কৃষক তার শেষ মুরগিটা জবাই করে নিঃস্বার্থভাবে আমাদের খাওয়ালেন।’ (মা বলেছিলেন জিতে এসো, হেরে যেও না, পৃষ্ঠা-১৫)

আরও পড়ুন

স্বপ্নের সাথে বৈরিতা: অস্তিত্ব ও আত্মবোধের লড়াই বিষাদের ছায়া: শফিক রিয়ানের জীবন-দর্শন

যুদ্ধের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে লে. কমান্ডার মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন বীরউত্তম (অব.) তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—মুক্তি ও স্বাধীনতা—এই দুই শব্দই আমাকে অনুপ্রাণিত করল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে।’ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দুটি শব্দে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে যাই, পৃষ্ঠা-২৯) এমনই অনেক মর্মস্পর্শী ও অনুপ্রেরণাদানকারী ঘটনায় সমৃদ্ধ হয়েছে ‘বীরের মুখে বীরত্বগাথা’ বইটি। সারাবাংলার আপামর মানুষের ভালোবাসা ও সহযোগিতার কথা উঠে এসেছে এসব সাক্ষাৎকারে। যে যেভাবে পেরেছেন, দেশ স্বাধীন করতে এগিয়ে এসেছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

বইটি না পড়লে বোঝাই যাবে না যে, একেবারে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষও কীভাবে সাহায্য করেছেন। এই বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি, চাঁদপুরের ‘নুরু চোরা’ও মজুমদারবাড়ির যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এমনকি স্মাগলাররাও জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস (অব.) বলেছেন, ‘১ নম্বর সাবসেক্টরে আমার যুদ্ধের এলাকা ছিল সিংহারপুর। আমরা রাতের আঁধারে দেশের মধ্যে ঢুকে গুলি করে বোমা মেরে পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্থির করে রাখতাম। এভাবে চার মাস আমি পাঁচ/ছয়টি অপারেশনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ৩ নম্বর সেক্টরের সিংহারপুরে যখন যুদ্ধ করি, সেটা ছিল স্মাগলিং এলাকা। স্মাগলাররা রাতের আঁধারে নীরবে চলত। যুদ্ধের সময় ওরা আমাদেরকে অনেক সহযোগিতা করেছে। ওরাই আমাদের রাস্তাগুলো দেখিয়ে দিত। কোথায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আছে, সেগুলোও আমরা ওদের কাছ থেকে জানতে পারতাম। ওরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে।’ (রাতের আঁধারে স্মাগলাররাই আমাদের পথ দেখিয়ে দিত, পৃষ্ঠা-৭০)

Advertisement

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা গাজী হয়ে ফিরেছেন, তাঁদের মুখ থেকে শোনা গল্পই তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে। সেখানে উঠে এসেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাহায্যের প্রসঙ্গও। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের একটি পরিসংখ্যান বা চিত্র আমরা পাই ‘বীরের মুখে বীরত্বগাথা’ বইতে। গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীরউত্তম (অব.) এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা কলকাতায় অপেক্ষা করছিলাম বিমানবাহিনী গঠনের জন্য। কিন্তু সমস্যা হলো, বাহিনী গঠন করে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বিমান পাওয়া যাচ্ছিল না। বাংলাদেশ যদি ভারতের ফাইটার বিমান ব্যবহার করে এবং কোনভাবে যদি তা বিধ্বস্ত হয় বা শত্রুসেনার হাতে যায় তবে তো সেখানে ভারতীয় পতাকা থাকবে। ভারত তো অফিশিয়ালি তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে সরাসরি সাহয্য করছে না।’ (সাতবার রিফাইনারি ডিপোতে বোম্বিং করে ধ্বংস নিশ্চিত করি, পৃষ্ঠা-১১১)

এমন অনেক ঘটনা আমরা জানতে পারবো ‘বীরের মুখে বীরত্বগাথা’ বইয়ের বিভিন্ন শিরোনামে। যেমন—১. ফিরে দেখি, চার যোদ্ধার মাথার খুলি পড়ে আছে (পৃষ্ঠা-১৮)২. আমাকে ফেলে যেও না, সঙ্গে নিতে না পারলে মেরে যেও (পৃষ্ঠা-২৩)৩. গোলাগুলির পর দেখি পাকিস্তানি ১১ সৈন্যের লাশ পড়ে আছে (পৃষ্ঠা-৪৩)৪. কিশোরী মেয়েটি গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লো (পৃষ্ঠা-৫৩)৫. বগুড়ায় প্রথম অ্যামবুশে ২৩ সৈন্য নিহত হয় (পৃষ্ঠা-৫৮)৬. স্বাধীনের পর আমরা সেই মায়েদের খোঁজ নিতে পারিনি (পৃষ্ঠা-৭৭)৭. ছেলে শহিদ হয়েছে জেনে আব্বা বিছানায় পড়লেন, আর দাঁড়ালেন না (পৃষ্ঠা-১০১)৮. গ্রামবাসী দা-কুড়াল নিয়েই আমাদের সঙ্গে বাংকারে বসে গেল (পৃষ্ঠা-১০৫)৯. মা বলেছিলেন, বুলেট যেন তোমার পেছনে না লাগে (পৃষ্ঠা-১১৬)১০. দেহরক্ষীকে বন্দুক দিয়ে বললাম, ধরা পড়লে যেন গুলি করে (পৃষ্ঠা-১২৬)

এমন মর্মস্পর্শী ২৫টি শিরোনাম রয়েছে ‘বীরের মুখে বীরত্বগাথা’ বইটিতে। তাই বইয়ের প্রতিটি ঘটনাই আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। বর্তমান প্রজন্মকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাবে। একাত্তরের রণাঙ্গনের সেইসব স্মৃতি বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমার দাবি, বইটি সবার জন্য অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। আশা করি দেশপ্রেমিক নাগরিক বইটিকে আপন করে নেবেন। আমি বইটির বহুল পাঠ, প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।

এসইউ/এমএস