মতামত

চাকরির পাশাপাশি কীভাবে ব্যবসা দাঁড় করাবেন?

চাকরির পাশাপাশি কীভাবে ব্যবসা করা যায়- এ ব্যাপারে অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। যারা চাকরি করছেন তাদের সেই স্যালারিতে চলছে না। চাকরি ছাড়া অন্য কোনো সূত্র থেকে আয় করা যায় কীভাবে তারা ভাবছেন। অনেকের চাকরিটা একঘেয়েমি লাগছে, ভালো লাগছে না। তারা ক্লান্ত। চাকরিতে থাকা অবস্থায় একটা ব্যবসা দাঁড় করানো গেলে ব্যবসাটা ধীরে ধীরে বড় হবে, ওখান থেকে টাকা আসতে থাকবে এবং একটা সময় চাকরিটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করা যাবে। আমার আজকের আলোচনায় উপরের এই দুই গ্রুপের চিন্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।

Advertisement

যারা ভাবছেন চাকরিতে থেকে পাশাপাশি একটা ব্যবসা দাঁড় করাবেন- তারা আর একটু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। সত্যিই কি আপনি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন, নাকি চাকরিটাও থাকবে পাশাপাশি ব্যবসা ও থাকবে? এ ব্যাপারে মনস্থির করতে বলছি তার একটা কারণ আছে বৈকি। কারণ হলো আপনি যদি পরে পুরোপুরি ব্যবসায়ী হতে চান সেটার প্রসেস একরকম আর যদি মনে করেন, না আপনি চাকরিও করবেন সাথে ছোটখাটো একটা ব্যবসাও থাকবে চাকরি কখনো ছাড়বেন না, তাহলে ব্যাপারটা ভিন্ন রকম।

চাকরির সাথে ব্যবসা না করে ইনকাম বৃদ্ধির আর কি কি উপায়ে আছে সেটা নিয়ে চিন্তা করা যায়। সেক্ষেত্রে যদি আপনি গভীর মনোযোগ দেন তাহলে দেখবেন ইনকাম বৃদ্ধির আরও একাধিক ক্ষেত্র আছে- যে ক্ষেত্রগুলোতে আপনি আপনার কোয়ালিটি, যোগাযোগ, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে ঠিকই একটা পথ বের করে নিতে পারবেন। আসলে চাকরির পাশাপাশি আপনি আইনগতভাবে একটি ব্যবসা করতে পারবেন না।

তবে যদি সিদ্ধান্ত নেন যে আপনি যে চাকরি করছেন সে চাকরি আর করবেন না, আপনি যে কোনো কারণে টায়ার্ড বা আপনি মনে করছেন যে চাকরি আপনার জন্য সঠিক নয় বা আপনার চাকরি ভালো লাগছে না, আপনি ব্যবসায়ী মেন্টালিটির মানুষ, আপনি ব্যবসা করলে স্বাধীন পেশায় ভালো করবেন এবং চাকরিতে আপনি বেশি অগ্রসর হতে পারবেন না কিন্তু ব্যবসা করলে আপনি খুব গ্রো করতে পারবেন, তাহলে ব্যবসা আপনার জন্য ঠিক আছে। তবে সেখানে আপনার ভালো প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। আপনার হোমওয়ার্ক করার ব্যাপার আছে, নিজেকে আপডেট করার ব্যাপার আছে, আপনার ব্যবসার আদ্যোপান্ত বোঝার, পরিকল্পনা করার ব্যাপার আছে, সেটা বাস্তবায়ন করার বিষয় আছে।

Advertisement

ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে সবাই মনে করে প্রথমেই অনেক টাকা লাগবে। সেজন্য আগে টাকাটা জোগাড় করার চেষ্টা করে। কিন্তু টাকা প্রথম লাগবে না, টাকা লাগবে শেষের দিকে গিয়ে। ইভেন আপনি যদি সেই পরিমাণ প্রস্তুত ও দক্ষ হন, আপনার টাকা নাও লাগতে পারে। আপনি অন্যের টাকায় ব্যবসা করতে পারেন।

তাহলে প্রথম কি করা দরকার? প্রথম খাতা-কলম নিয়ে আপনি বসবেন। বসবেন কেন? আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা, আপনার অভিজ্ঞতা কোন ব্যবসার সাথে যায়, সেটা আপনি আগে ঠিক করবেন। আপনি কি মুদির দোকান দেবেন, চায়ের দোকান দেবেন, আপনি কি একটা কফি শপ দেবেন, আপনি কি একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দেবেন, কোন বড় গ্রুপের ডিলারশিপ নেবেন, নিজেকে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের সাথে সম্পৃক্ত করবেন, নাকি কোনো কারখানা করবেন? কি করবেন আসলে আপনি? আপনি কি কনসাল্টিং বিজনেস শুরু করবেন? অনেক ধরনের ব্যবসা আছে তার মধ্যে আপনার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা মিলিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে প্রথমে যে আপনি কি ব্যবসা করবেন।

এখন ধরেন, আপনি ঠিক করলেন আপনি একটা রেস্টুরেন্ট করবেন। তাহলে প্রথম ডিসিশন আপনি নিয়ে ফেলেছেন যে আপনি রেস্টুরেন্ট করবেন। এবার আপনি স্টাডি শুরু করুন যে আপনি যে জায়গায় থাকেন সেখানে কোথায় রেস্টুরেন্ট করতে চান? কি ধরনের করতে চান? রেস্টুরেন্ট করতে আপনার কী কী লাগবে, কত আয়তনে হবে ইত্যাদি। কত জন লোক হায়ার করবেন, রেস্টুরেন্টের বাজারগুলো কোথা থেকে করবেন, কারা এগুলো আনবে, কি দামে আনবে। কারা এগুলো রান্না করবে, প্রসেস করবে কীভাবে, সেল করবেন কি প্রাইসে- টোটাল কাজ চালানোর জন্য আপনার কতগুলো লোক লাগবে। তাদের স্যালারি কেমন হবে, ভাড়া কেমন হবে, কি কি লাইসেন্স লাগবে, সব একসাথে নিয়ে একটা হোমওয়ার্ক করবেন।

আপনি যেহেতু চাকরি করছেন চাকরি শেষে বাসায় এসে রাতে এ কাজগুলো শুরু করবেন। আপনি ইন্টারনেট সার্চ করে হোমওয়ার্ক আগে করে নেবেন। হোমওয়ার্ক ভালোভাবে করার পর আপনার যদি মনে হয় এই বিজনেস আপনি করতে পারবেন বা করবেন তাহলে দ্বিতীয় ধাপটা হচ্ছে তাদের সাথে মিট করা যারা এ কাজগুলো করে। তাদের বিজনেসের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা। পরিচিত লোক কেউ না থাকলে ছোট একটা মার্কেট সার্ভে করা প্রয়োজন। মার্কেট সার্ভে করে আপনার রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী তারা একটা রিপোর্ট করে দেবে।

Advertisement

মনে রাখবেন আপনি ব্যবসার জন্য পা বাড়াচ্ছেন এখানে আপনার ইনভেস্টমেন্ট আছে প্রথমে ছোট ছোট ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে। তৃতীয় ধাপে আপনি চাকরিরত অবস্থায় যেহেতু বিজনেসে পুরোপুরি জয়েন করতে পারছে না, আপনার বিশ্বস্ত একজন লাগবে যাকে আপনি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করতে পারেন, যার ফিন্যান্সিয়াল সততার ব্যাপারে আপনার ধারণা আছে, যার কাজের দক্ষতা সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে, যে এই কাজটা পরিচালনা করতে পারবে। যাকে নিয়োগ দেবেন সে একটা টিম গোছাবে আপনার সহযোগিতা নিয়ে।

যখন সময় পাবেন সময় দিয়ে আপনি হেল্প করবেন । অর্থাৎ আপনি চাকরি করবেন এবং চাকরির পাশাপাশি এটা ডেভেলপ করবেন। ইট ইজ নট আ ইজি ম্যাটার টু ডু। সুতরাং এখন আপনার চাকরির পরে বাকি সময়টা আপনার এদিকে দিতে হবে। এক প্রকার ঘুম খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে পরিবারকে সময় খুব কম দিয়ে। কিন্তু পরিবারের সবার সাপোর্ট আপনার লাগবে।

যা হোক আপনি এবার শুরু করবেন, কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়? মনে রাখতে হবে প্রথম যে টাকাটা বিজনেসে ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে লাগবে সে টাকা কোনো প্রতিষ্ঠান কিন্তু আপনাকে দেবে না। স্টার্ট অব ফাইন্যান্সিং এখন আছে কিন্তু আপনি রেস্টুরেন্টে পাবেন না। প্রথম টাকাটা আসতে হবে আপনজনদের কাছ থেকে। মা, বাবা, ভাই, বোন, বন্ধু-বান্ধব ও নিজের থেকে। নিজের টাকা থেকে সম্ভব না হলে আপনার আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব কাউকে পার্টনার হিসেবে নিতে পারেন। শুরুতে আপনি বাইরের পার্টনার নিতে পারবেন না কারণ তারা আপনাকে বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা শুরুর কষ্টটা আপনাকে একাই করতে হবে। যারা আপনার পরিবারকে চেনে জানে, আপনার যোগ্যতাকে ট্রাস্ট করে তারা এগিয়ে আসবে।

আপনি ব্যবসা শুরু করে দিলেন। রিস্কটা হলো রেস্টুরেন্ট চলবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যাশ টাকা আসবে কিন্তু আপনি সারাদিন সময় দিতে পারছেন না, দেবেন হয়তো সন্ধ্যায়। সন্ধ্যায় এসে আপনাকে পর দিনের বাজার কি হবে, কত বেচা বিক্রি হলো, প্রতিদিন আপনাকে একাউন্টটা ভালোভাবে দেখতে হবে। কত টাকা এলো কত টাকা গেলো -কত টাকা লাভ হচ্ছে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার ভালো দিক হলো এটা নগদে বিক্রি হয় বাকিতে নয়। প্রতিদিনের বিক্রির টাকাটা ক্যাশে জমা হয়। এতে টাকা চুরির সম্ভাবনা থাকে।

সেক্ষেত্রে আপনি কম খরচে সিসি ক্যামেরা লাগাতে পারেন। যদি রেস্টুরেন্টের লোকেশন, পজিশন ভালো হয়, রান্না ভালো হয়, টিম সার্ভিস ভালো হয়, বাবুর্চি ভালো হয়- তখন রেস্টুরেন্ট দাঁড় করাতে বেশি বেগ পেতে হয় না, অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তবে মন দিয়ে লেগে থাকার একটা ব্যাপার আছে। ছয় মাস বা এক বছরে আপনি বুঝতে পারবেন যে ব্যবসাটা কোন দিকে যাচ্ছে।

আপনি চাকরিতে যে বেতন পান রেস্টুরেন্টে ফুল টাইম দিলে এখান থেকে যদি বেশি না পান তাহলে হুট করে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেবেন না। যদি মূলধনের বাইরে আপনার ফ্যামিলি নিয়ে চলার মতো দুই বছরের ইমার্জেন্সি ফান্ড থাকে তাহলে রিস্কটা নিতে পারেন আপনি দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাসী হলে চাকরির সাথে ব্যবসাটা চালাতে। তারপর একসময় ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে চাকরি ছেড়ে ফুলটাইম ব্যবসায়ী।

ইস্পিরিট তা হচ্ছে “চাকরি করবো না অন্যকে চাকরি দেব”। সবাই ভালো থাকবেন, আমার সাথে থাকবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস