জাতীয়

টাকা না দিলে মেরে ফেলবে, শুনে মূর্ছা যাচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী

‘আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের মেরে ফেলবে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিও।’

Advertisement

স্ত্রী মিনা আজমিনকে পাঠানো শেষ ভয়েস মেসেজে এই কথাটুকুই বলেছেন জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মো. আতিক উল্লাহ খান।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) প্রথম রোজার ইফতারের পর স্বামীর পাঠানো এই মেসেজ পেয়ে বারবার মূর্ছা যান আতিক উল্লাহ খানের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতেই নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আতিক উল্লাহ খানের মা শাহনুর বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যখন ইফতার করছিলাম, এর মাঝেই আমার ছেলে ভয়েস মেসেজে জানায়, তাদের সবার মোবাইল নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জাহাজটি সোমালিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

Advertisement

জিম্মি নাবিক আতিক উল্লাহ খানের পরিবারের সদস্যরা

‘‘কিছুক্ষণ পর তার স্ত্রীকে পাঠানো মেসেজে জলদস্যুরা টাকা দাবি করেছে বলে জানায়, না হলে ওদের মেরে ফেলবে। বিষয়টা সবাইকে জানাতে বলেছে সে। এটা শোনার পর থেকে আতিকের স্ত্রী বারবার বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। সে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আরও তিনটা মেয়ে আছে। মেয়েরা বারবার এসে জানতে চাইছে, কান্নাকাটি করছে, ‘আমাদের বাবা কোথায়’ বলে।” বলেন শাহনুর বেগম।

আরও পড়ুন

সোমালিয়ান জলদস্যুদের দখলে বাংলাদেশি জাহাজ, ২৩ নাবিক জিম্মি

এর আগে মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে আতিক তার স্ত্রী মিনাকে বলছিলেন, ‘কয়েক দিন আমাকে ফোনে পাবে না। আমি নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবো।’

Advertisement

জিম্মি নাবিক আতিকের বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায়। মা, স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকতেন শহরের নন্দনকানন এলাকায়।

এর আগে মালিকপক্ষের কাছে পাঠানো এক ভয়েস বার্তায় ওই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে জানান বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান।

তিনি বলেন, ‘গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টা)। এই সময় একটা হাই স্পিডবোট (দ্রুতগতির স্পিডবোট) আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আল্যার্ম দেই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা (জলদস্যুরা) চলে এলো।’

আরও পড়ুন

পরিবারের খোঁজ নিও, বেঁচে এলে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ

আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেললো। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই এলাম। এ সময় কিছু গোলাগুলি করলো। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারও গায়ে হাত দেয়নি। এর আগে জিম্মি করা ইরানের মালিকানাধীন একটি মাছ ধরার জাহাজ দিয়ে তারা সাগরে বড় জাহাজ খুঁজতেছিল। আমাদের জাহাজটি থামিয়েছে তারা। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’

এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি ২৩ নাবিক

আতিক উল্লাহ খানের বন্ধু জুলকার নাইম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিকেল (মঙ্গলবার) সাড়ে ৪টার দিকে আমাকে ভয়েস মেসেজ পাঠায় আতিক। সে বলে, ‘দোয়া করিস পরিবারকে দেখাশোনা করিস।’ ওই এক মিনিটই কথা হয়েছে। ওয়াসরুম থেকে এ কথাগুলো বলেছিল সে। এরপর আর যোযোগ হয়নি।’

মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহতে জিম্মি আছেন ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রু। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে জাহাজটি জলদস্যুর কবলে পড়ে। এরপর বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটি ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়া নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে দস্যুরা। বর্তমানে নাবিকদের ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

এমভি আবদুল্লাহর বর্তমান অবস্থান/সূত্র: বিএমএমওএ

সর্বশেষ সন্ধ্যা ৭টার দিকে জাহাজের নাবিক আসিফুর রহমান ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে আমরা আক্রমণের শিকার। আমরা সবাই সুস্থ ও নিরাপদে আছি। আমাদের প্রার্থনায় রাখুন।’

এদিকে বুধবার (১৩ মার্চ) সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশি জাহাজটি এখন উপকূল থেকে প্রায় ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে। সোমালিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

জলদস্যুরা সোমালিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি জাহাজ

এমভি আব্দুল্লাহ দেশের শীর্ষ শিল্প গ্রুপ কেএসআরএম’র মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজ। এর দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। প্রথমে জাহাজটির নাম ছিল ‘গোল্ডেন হক’। বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর এর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। এটি একটি বাল্ক কেরিয়ার।

জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ/ছবি: সংগৃহীত

বৈশ্বিক জাহাজের অবস্থান নির্ণয়কারী সাইট মেরিন ট্রাফিক জানিয়েছে, জাহাজটি ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর ছেড়ে আসে। ১৯ মার্চ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। তার আগেই এর দখল নেয় জলদস্যুরা।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লায় জিম্মি যারা

জিম্মি নাবিকদের মধ্যে রয়েছেন- জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর গোসাইলডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা। চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলার বরকলে, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার বাসিন্দা, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন টাঙ্গাইল জেলার নাগপুর থানার বাসিন্দা, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামানের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলায়, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম ও থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ ও ইলেকট্রিসিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ ফেনী জেলার বাসিন্দা, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থানায়।

এছাড়া ক্রু দের মধ্যে মো. শরিফুল ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরের বন্দর থানা এলাকায়, মো. আসিফুর রহমানের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, মোশাররফ হোসেন শাকিল ও আইনুল হকের বাড়ি মিরসরাই উপজেলায়। মো. সাজ্জাদ হোসেন, নুর উদ্দিন ও মোহাম্মদ সামসুদ্দিনের বাড়ি চট্টগ্রামের কর্ণফুলি উপজেলায়। মো. আনোয়ারুল হকের বাড়ি নোয়াখালির কোম্পানিগঞ্জ, জয় মাহমুদের বাড়ি নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া, মো. নাজমুল হকের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কামারাখন্দ ও মো. আলী হোসেনের বাড়ি বরিশালে বানাড়িপাড়া গ্রামে।

এএজেড/ইএ/এমএস