একুশে বইমেলা

বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা: নির্মোহ পর্যবেক্ষণ

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, ফিচার, প্রবন্ধ ও কলাম লিখে থাকেন। এ পর্যন্ত তার ১৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কথাশিল্পী হিসেবে বেশ আলোচিত তিনি। একটি উপন্যাস, চারটি গল্পের বই পড়লে তার প্রতি সমীহ জাগবে। কবি হিসেবেও ভালো করছেন। এছাড়া দুটি সম্পাদনাধর্মী বই প্রকাশ করেছেন। তবে আমার আলোচনার বিষয় হচ্ছে তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা’।

Advertisement

তার দ্বিতীয় প্রবন্ধের বই ‘বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা’। বইটি প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন। ‘বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা’র সূচিপত্র এমন: ‘কল্লোল যুগের গল্পকারদের শিল্পপ্রবণতা’, ‘বাংলা কবিতায় বর্ষার শিল্পরূপ’, ‘বাংলা ছোটগল্পের প্রবণতা ও শিল্পপ্রকৌশল’, ‘কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বহুমুখী আবেদন’, ‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শকুন্তলা’র শিল্পরূপ’, ‘সাম্প্রতিক ছোটগল্পের গতি-প্রকৃতি’, ‘একুশ শতকের প্রবন্ধচর্চা কোন পথে?’, ‘কতিপয় শহীদের উক্তি’র বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপ’, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার শিল্পস্বর’, ‘হুমায়ূন আহমেদের নাটকের শিল্পপ্রবণতা ও গৃহকর্মী চরিত্র’, ‘শিল্পের কাছে দায়বদ্ধতা’, ‘বাংলা কবিতায় ঋতুর রানি’, ‘লেখাকে আগে শিল্প হতে হবে’, ‘কালজয়ী পাঁচ গল্পের শিল্পরূপ’, ‘বাংলা সাহিত্যে শীতের হাওয়া’।

বইটিতে মূলত বাংলা সাহিত্যে যেসব শিল্পপ্রবণতা প্রতিফলিত হয়েছে, তারই কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ-বই থেকে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন ধারা, প্রকাশ ও প্রচার ইত্যাদি দর্শন তুলে ধরতে পারি। সামাজিক যোগযোগমাধ্যম, কবিতা, মঞ্চ নাটক, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি। ‘কল্লোল যুগের গল্পকারদের শিল্পপ্রবণতা’ প্রবন্ধে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। কল্লোল পত্রিকা বা গোষ্ঠীর ইতিহাস, লেখক, কবি, প্রকাশনা, বৈশিষ্ট্য, নানা সংকট, সমাজ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি। আধুনিক কবিতার রেশ শুরু আসলে সেখান থেকেই। পরে আরও গতিশীল হয়। নন্দনকলা নিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘বাংলা ছোটগল্পের প্রবণতা ও শিল্পপ্রকৌশল’ প্রবন্ধে। তবে শিল্পপ্রকৌশল নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা যেত।

প্রবন্ধগুলো পড়ে প্রাবন্ধিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের জীবন, দর্শন ও মতামত জানা যাবে। এই জেনে যাওয়াটা মনে হয় দারুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তার প্রবন্ধগুলোতে। এ ক্ষেত্রে তিনি সফল বলেই মনে করি। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাহিত্য সমালোচক হতে হলে সাহিত্য-তত্ত্বের পাশাপাশি ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন তত্ত্ব ও টার্ম সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এ ধারণা ও জানার পরিমাণের ওপরই নির্ভর করে প্রবন্ধের মান। ধর্মীয় নেতা যেমন পড়তে হবে, কার্ল মার্ক্স-লেনিনও পড়তে হবে। ইলিয়ট-রবীন্দ্রনাথ যেমন পড়তে হবে, বঙ্গবন্ধুকেও পড়তে হবে। বিভিন্ন সভ্যতার পাশাপাশি রাজনীতির বিষয়াদিও জানতে হবে। সিরাজউদ্দৌলা-মীরজাফর-ক্লাইভ যেমন থাকবে; বিজয়ী বীরদের গল্প বা কাহিনিও জানা থাকা আবশ্যক। সমন্বয় ও অভিযোজন করে প্রবন্ধে যুৎসই উদাহরণ উপস্থাপন বা অবতারণা পাঠকের রুচিতে নতুনত্ব দেয়, আরও পড়ার অনুপ্রেরণা দেয়।

Advertisement

আরও পড়ুন

বিষাদের ছায়া: শফিক রিয়ানের জীবন-দর্শন অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী: একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস

বাংলা শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন পর্যায় ও সেগুলোর বৈশিষ্ট্য, ইতিবাচকতা-নেতিবাচকতার বিভিন্ন পর্যায় ও পর্যবেক্ষণ তার প্রবন্ধে উঠে এসেছে। আরও কিছু সময় নিলে অনেক প্রবন্ধ উন্নততর হতো বলে মনে করি। আলাদা টোন সৃষ্টি করা গেছে কিংবা সাহিত্য-সমাজে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে, তার ওপর নির্ভর করে প্রবন্ধের মান। হয়তো সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ভবিষ্যতের পাঠক এগুলো বিচার ও মূল্যায়ন করবেন।

সামগ্রিক মূল্যায়ন করতে গেলে বলা যায়, অভিজ্ঞতা বাড়ার পাশাপাশি প্রবন্ধের মান বাড়ছে বলে আমার মনে হয়েছে। বইয়ের বাইরে কিছু মাধ্যমে তার প্রকাশিত প্রবন্ধের মান তুলনামূলক ভালো লেগেছে। পরিচিত বিষয়াদির বাইরে খুব কম বিষয় অবতারণা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। তবে সত্যিকার প্রবন্ধ লেখার দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। এ ক্ষেত্রে বিষয়ের খুব গভীরে ঢোকাটা খুবই জরুরি। লেখার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা স্টাইল (ভাষা, উপস্থাপন-কৌশল, তথ্যাদি, নতুন কিছু অবতারণা ইত্যাদির মাধ্যমে) সৃষ্টি করতে পারলে তিনি ভালো প্রাবন্ধিক হিসেবে মূল্যায়িত হবেন। প্রবন্ধ সাহিত্যের এ-দুর্দিনে তাকে আমাদের প্রয়োজন।

অনেক বিষয়ের গভীরে ঢুকতে চেয়েছেন কিন্তু স্থায়ী হতে পেরেছেন কমই। তার অন্য মাধ্যমে প্রকাশিত প্রবন্ধের বেশিরভাগই সাহিত্যবিষয়ক। প্রবন্ধ মননশীল বিষয় বলে লেখকের স্বাধীনতা কম থাকে। এক বা একাধিক থিম উপস্থাপন করে তার সপক্ষে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করার চেষ্টাই প্রবন্ধের মূল কাজ। কতদূর পেরেছেন তিনি? সার্বিক মূল্যায়নের এখনো সময় হয়নি। কিন্তু ভোরের সূর্য বলে দেয় দিনটা কেমন যেতে পারে। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ প্রতিশ্রুতিশীল প্রাবন্ধিক। বাংলা সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনার জন্য তত্ত্বীয় ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে অগ্রগামী তিনি। আর সম্পাদনার জন্য বিভিন্ন লেখকের (একটা বড় অংশ) বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড ও লেখালেখি ওয়াচডগের মতো পর্যবেক্ষণ করছেন। ভালো কিছু গ্রহণ ও মন্দগুলো বর্জনে প্রবন্ধে তিনি ক্রমশ আলোকিত হচ্ছেন। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।

Advertisement

বইয়ের নাম: বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতালেখকের নাম: সালাহ উদ্দিন মাহমুদপ্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশনপ্রচ্ছদ: চারু পিন্টুমূল্য: ৩০০ টাকা।

এসইউ/এমএস