জাতীয়

চট্টগ্রামে রোজার শুরুতেই ‘হাওয়া’ ওয়াসার পানি

• বোতলজাত পানিতে সেহরি সেরেছেন অনেকে• হালদার পানিতে ২৬০০ এমএলডি লবণ• কর্ণফুলীতে কমেছে পানির স্তর• ওয়াসার দৈনিক উৎপাদন কমেছে ৮ কোটি লিটার

Advertisement

‘সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি পানির কল থেকে পানি বেরোয় না। বাড়ির কেয়ারটেকার জানালেন- দুদিন ধরে ওয়াসার পানি নেই। কোনো ঘোষণা ছাড়া ওয়াসা পানি সরবরাহ বন্ধ করেছে। রমজানের প্রথম দিনে পানি না পাওয়ায় মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।’

ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দা সোহেল। শুধু সোহেল বা তার বাড়ি মালিক নন, চট্টগ্রামে কম বেশি পানি সংকটে আছেন ৭৮ হাজার গ্রাহকের সবাই। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের অনেক এলাকায় সারাদিনেও মিলছে না পানি। উঁচু এলাকাগুলোতে পানির সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

ওয়াসা বলছে, হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে লবণাক্ততা বাড়ায় দৈনিক পানি উৎপাদন কমেছে আট কোটি লিটার। এছাড়া সঞ্চালন লাইনের ফুটোর কারণে প্রতিদিন ‘হাওয়া’ হয়ে যাচ্ছে আরও আড়াই কোটি লিটার পানি। এ অবস্থায় রমজানে নগরীবাসীর জন্য পানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিকল্প ভাবছেন তারা।

Advertisement

হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে লবণাক্ততা বাড়ায় দৈনিক পানি উৎপাদন কমেছে আট কোটি লিটার। এছাড়া সঞ্চালন লাইনের ফুটোর কারণে প্রতিদিন ‘হাওয়া’ হয়ে যাচ্ছে আরও আড়াই কোটি লিটার পানি। এ অবস্থায় রমজানে নগরীবাসীর জন্য পানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিকল্প ভাবছেন তারা

প্রথম রোজার দিনে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর, পতেঙ্গা, কাট্টলী, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, দেওয়ান বাজার ও মুরাদপুর এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দারা ওয়াসার পানি পাচ্ছেন না। অনেকের অভিযোগ, মাঝরাতে সেহরির সময়ও তারা পানি পাননি। এত রাতে দোকানপাটও বন্ধ ছিল। এতে প্রথম সেহরিতেই তাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

আরও পড়ুন• অষ্টমবারের মতো চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহফ্লাইওভারে আটকায় ল্যাডার, থেকেও অকার্যকর ফায়ার হাইড্রেন্ট

এ অবস্থায় নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা রাতে ও সেহরিতে ব্যবহার ও খাবার জন্য বাজার থেকে জারের পানি বা বোতলজাত পানি কিনতে বাধ্য হয়েছেন। এতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের মধ্যে লিটার লিটার পানি কেনা তাদের জন্য ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

Advertisement

কাতালগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সোনিয়া আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওয়াসার পানি না আসায় রাতে ১৫ লিটারের পানির জার কিনেছি। দাম রেখেছে ১০০ টাকা। রাতে আর সেহরিতেই সেই পানি শেষ। এখন ইফতারের জন্য আরও এক জার পানি লাগবে।’

নগরের পতেঙ্গা এলাকার মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল রাত থেকে বাড়িতে পানি নেই। সেহরিতে বোতলজাত পানি কিনে খেয়েছি, কিন্তু ওজু-গোসল কীভাবে করবো বুঝতে পারছি না। প্রতিবছর শুনি ওয়াসার নতুন নতুন প্রকল্প হয়, কিন্তু শুষ্ক মৌসুম এলেই তাদের সব জারিজুরি শেষ হয়ে যায়। রমজানে পানির সংকটের বিষয়টি আগে থেকেই ভাবা উচিত ছিল।’

চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘পানির সংকটটা বেশি ভোগায় গৃহিণীদের। রমজানে পানির প্রয়োজন এমনিতেই বেশি। সেখানে একেবারে ঘোষণা ছাড়া পানি বন্ধ রাখা অমানবিক।’

আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুস্মিতা বড়ুয়া অভিযোগ করেন, গত কয়েকদিন ধরে ওয়াসার পানিতে লবণ আসছে।

গতকাল রাত থেকে বাড়িতে পানি নেই। সেহরিতে বোতলজাত পানি কিনে খেয়েছি, কিন্তু ওজু-গোসল কীভাবে করবো বুঝতে পারছি না। প্রতিবছর শুনি ওয়াসার নতুন নতুন প্রকল্প হয়, কিন্তু শুষ্ক মৌসুম এলেই তাদের সব জারিজুরি শেষ হয়ে যায়। রমজানে পানির সংকটের বিষয়টি আগে থেকেই ভাবা উচিত ছিল

বিষয়টি উঠে এসেছে ওয়াসার ল্যাবরেটরি পরীক্ষায়ও। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে হালদার পানিতে অতিরিক্ত লবণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি লিটার পানিতে সর্বনিম্ন ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ২৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণের উপস্থিতি মিলছে।

আরও পড়ুন• অটোমেশনের আওতায় আসছে চট্টগ্রাম ওয়াসাপানির বিল তৈরি করতে নতুন প্রকল্প চালু

এ অবস্থায় জোয়ারের সময় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পানি উৎপাদন বন্ধ রাখছে ওয়াসা। তাতে কমে গেছে ওয়াসার দৈনিক পানি উৎপাদন। লবণের কারণে সোমবার (১১ মার্চ) প্রায় ৮ কোটি লিটার পানি কম উৎপাদন হয়েছে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম।

তিনি বলেন, ‘হালদার পানিতে সর্বোচ্চ ২৬০০ মিলিগ্রাম লবণ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে পানির লেভেল কমেছে মাইনাস ফিফটিন (-১৫) পর্যন্ত, যা স্বাভাবিক সময়ে থাকে মাইনাস ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ (-১.৫) মাত্রায়। একই সঙ্গে কর্ণফুলীতে পানির লেভেল কমেছে থ্রি পয়েন্ট ফাইভ (-৩.৫) মাত্রায়।

‘এ কারণে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প ও মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্পের প্রায় ২৫ শতাংশ পানি উৎপাদন কমে গেছে। বর্তমানে রেশনিংয়ের মাধ্যমে নগরীতে পানি সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এছাড়া গভীর নলকূপ চালু ও নদীতে চ্যানেল কেটে পানিপ্রবাহ বাড়ানো চেষ্টা হচ্ছে’- বলেন প্রকৌশলী মাকসুদ আলম।

চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, দৈনিক ৫০ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার ৯২ শতাংশ পানির উৎস হালদা ও কর্ণফুলী নদী। কিন্তু এখন দুই নদীতেই পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বেড়েছে লবণাক্ততা।

বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি আর বাণিজ্যিক সংযোগ সাত হাজার ৭৬৭টি। নগরে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ সংস্থাটির সেবার আওতায় রয়েছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক মোট পানির উৎপাদন ৫০ কোটি লিটার। এরমধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প ০১ ও ০২ থেকে ১৪ দশমিক ৩ কোটি লিটার করে মোট ২৮ দশমিক ৩ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হয়। মূলত কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিশোধন করা হয়। এছাড়া গভীর নলকূপ থেকে আসে চার কোটি লিটার পানি। তবে সিস্টেম লসের কারণে অ-রাজস্বভুক্ত খাতে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ পানি অপচয় হয়।

দৈনিক ৫০ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার ৯২ শতাংশ পানির উৎস হালদা ও কর্ণফুলী নদী। কিন্তু এখন দুই নদীতেই পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বেড়েছে লবণাক্ততা। বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি আর বাণিজ্যিক সংযোগ সাত হাজার ৭৬৭টি। নগরে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ সংস্থাটির সেবার আওতায় রয়েছে

চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, উজানে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার পরিমাণ কমে গেলে কর্ণফুলীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন• ঢাকায় পানির দৈনিক চাহিদা ২৬৫ কোটি লিটারএবার চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি পরীক্ষা করাতে হাইকোর্টের নির্দেশ

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যবস্থাপক এ টি এম আব্দুর জাহের জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাপ্তাই লেকে এখন পানি রয়েছে ৮০ দশমিক ০৫ ফুট মিন সি (এমএসএল) লেভেল। কিন্তু রুলকার্ভ অনুযায়ী এখন লেকে পানি থাকার কথা ৯০ ফুট এমএসএল। অর্থাৎ পরিমাপের চেয়ে কাপ্তাই লেকে এখন প্রায় ১০ ফুট পানি কম রয়েছে।’

সহসা বৃষ্টি না হলে কাপ্তাই লেকের পানি আরও কমে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন তিনি। এদিকে, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ব্যবহারে স্বাস্থ্য সমস্যার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. সুজাত পাল বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বেশি লবণাক্ত পানি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পানে কিডনি, হার্টের সমস্যা, ব্ল্যাড প্রেসার, ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে।’

এএজেড/এমকেআর/এএসএম