জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। শুধু এবার নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপির অনুপস্থিতির সুযোগে দশম জাতীয় সংসদ থেকেই প্রধান বিরোধী দলের আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে। রাজনীতিতে সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা কমে, বিরোধী দলেরটা বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। এখানে প্রধান বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা নিয়মিত কমছে।
Advertisement
দশম সংসদে জাতীয় পার্টির আসন ছিল ৩৪টি, একাদশে ২২টি। আর দ্বাদশ সংসদে মাত্র ১১টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছে জাতীয় পার্টি। তাও তারা সরকারি দলের অনুকম্পায় বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছে। চাইলে সরকার ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি গ্রুপ বানিয়ে তাদের বিরোধী দলের আসনে বসাতে পারতো।
এটা ঠিক সরকারি দলের অনুকম্পাতেই জাতীয় পার্টি সংসদের প্রধান বিরোধী দলের ‘মর্যাদা’ পেয়েছে। কিন্তু এই অনুকম্পাটাই তাদের জন্য কাল হয়েছে। মানুষ জাতীয় পার্টিকে বলে গৃহপালিত বিরোধী দল। তাদেরকে আর কেউ বিশ্বাস করে না। সরকারের দালালিই যদি করতে হয়, তাহলে সরাসরি আওয়ামী লীগ করাই ভালো, জাতীয় পার্টির মাধ্যমে ঘুরিয়ে করতে হবে কেন। এ কারণে বারবার বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ পেয়েও জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ৯১ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সেবার জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছিল। ক্ষমতা হারানোর পর সেটাই ছিল তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য। এখন কমতে কমতে আসন ১১তে ঠেকেছে। তাও আওয়ামী লীগের সাথে আসন সমঝোতার সুবাদেই তারা ১১টি আসন পেয়েছে। এককভাবে নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টি ভবিষ্যতে কোনো আসনই পাবে না হয়তো।
Advertisement
আগেই যেমনটি বলেছি, জাতীয় পার্টি যে সংসদে প্রধান বিরোধী দল, এটা মানুষ তো বিশ্বাস করেই না, আমার ধারণা জাতীয় পার্টি নিজেরাও নিজেদের বিরোধী দল বলতে লজ্জা পায়। এমন অদ্ভুত বিরোধী দল অবশ্য বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল। ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অংশীদার। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলও ছিল, আবার মন্ত্রিসভায়ও ছিল। একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার অতীত কোনো উদাহরণ নেই।
সমালোচনা যতই করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে জাতীয় পার্টিরই কিছু জনসমর্থন ছিল। আর এই জনসমর্থনকে পুঁজি করেই দলটি আজ এ ঘাটে তো কাল ও ঘাটে নৌকা ভেড়ায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মুখে পতনের পর কেউ ভাবেনি এরশাদ আবার এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ এই আপ্তবাক্যকে পুঁজি করে জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের জায়েজ করে নিয়েছে।
প্রথমে আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন এরশাদ। এরপর বিএনপির সাথে চারদলীয় জোট করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে জাতীয় পার্টি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের সাফল্যে আওয়ামী লীগ বুঝে যায়, তারা একা বিএনপির সাথে পারবে না। তাই জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নেয় আওয়ামী লীগ।
২০০৮ সালের নির্বাচন থেকেই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক। তবে জাতীয় পার্টিতে বরাবরই দুটি ধারা বিদ্যমান- একটি আওয়ামীপন্থি, অন্যটি আওয়ামী বিরোধী। রওশন এরশাদ বরাবরই আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত। এরশাদ বিভিন্ন সময়ে সরকার বিরোধী অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করলেও নানা কারণে পারেননি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি।
Advertisement
এমনকি জোর করলে তিনি আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু এরশাদকে অসুস্থ সাজিয়ে চিকিৎসার নামে সিএমএইচে আটকে রেখে আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যায়। এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখান থেকে বের হন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে। এরশাদের মত তার ভাই জিএম কাদেরও বিভিন্ন সময়ে সরকারের সমালোচনা করেন। এবারের নির্বাচনের আগেও তারা নির্বাচন থেকে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার নানা কৌশলে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়ে আসে।
নিন্দুকেরা বলেন, স্ত্রী শেরিফা কাদেরের আসনে সমঝোতা নিশ্চিত হওয়ার পরই জিএম কাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সমস্যাটা বাঁধে সেখানেই। সরকারের সাথে জাতীয় পার্টির সমঝোতা হয়েছিল ২৬টি আসনে। এসব আসনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী সরিয়ে নেয়। তবে স্বতন্ত্ররা ঠিকই মাঠে ছিলেন। তাতে জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরসহ ১৫ জনই পরাজিত হয়েছেন। মাত্র ১১ আসন নিয়ে সরকারের আনুকূল্যে বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ পাচ্ছে জাতীয় পার্টি।
অথচ বিএনপির অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টির সামনে সুযোগ ছিল সত্যিকারের বিরোধী দল হয়ে ওঠার। কিন্তু জাতীয় পার্টি সে সুযোগটি নেয়নি অথবা নিতে পারেনি। জাতীয় পার্টি যে সত্যিকারের বিরোধী হতে পারেনি, জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব যে আজ বিলীন প্রায়; তা আমার জন্য আনন্দদায়ক। আমরা যারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মাঠের কর্মী ছিলাম, তারা সবাই জাতীয় পার্টির দুর্দিনে আনন্দিত।
বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতিতে দেবর-ভাবীর সম্পর্কটা বেশ মধুর। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেবর-ভাবীর সম্পর্ক তিক্ততায় ঠাসা। দেবর-ভাবীর দ্বন্দ্বে জাতীয় পার্টি আবারও ভেঙ্গেছে। এরশাদ বেঁচে থাকতেও স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবে দশম ও একাদশ সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসনটি ছিল রওশন এরশাদের দখলে। তবে এবার তিনি সংসদেই নেই।
আসলে স্বৈরাচারী এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দুষ্টক্ষত। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টির কোনো আদর্শিক চরিত্র নেই। পুরোটাই সুবিধাবাধিতায় ঠাসা। ক্ষমতার হালুয়া-রুটির লোভে জড়ো হওয়া নেতাদের নিয়ে জন্ম নেয়া দলটির আসল চরিত্র উন্মোচিত হয় ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মাধ্যমে। এরশাদ পতনের পর থেকে জাতীয় পার্টি কতবার ভেঙ্গেছে, এখন ‘জাতীয় পার্টি’ নামে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত কয়টি সংগঠন আছে; তা একটি দারুণ গবেষণার বিষয়।
বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতিতে দেবর-ভাবীর সম্পর্কটা বেশ মধুর। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেবর-ভাবীর সম্পর্ক তিক্ততায় ঠাসা। দেবর-ভাবীর দ্বন্দ্বে জাতীয় পার্টি আবারও ভেঙ্গেছে। এরশাদ বেঁচে থাকতেও স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবে দশম ও একাদশ সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসনটি ছিল রওশন এরশাদের দখলে। তবে এবার তিনি সংসদেই নেই। এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হন তার ছোট ভাই জিএম কাদের। কিন্তু ভাবী রওশন এরশাদের সাথে তার সম্পর্ক বরাবরই ছিল অম্লমধুর। জিএম কাদেরের বিরোধী অংশটি বরাবরই রওশনকে সামনে রেখে রাজনীতি করে গেছে।
গত নির্বাচনের আগে দেবর-ভাবীর অম্লমধুর সম্পর্কটা তিক্ততায় গড়ায়। দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ ছিল আগে থেকেই। দেবরের প্রতি অভিমান থেকে আগের দুটি সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ এবার নির্বাচনেই অংশ নেননি। তার ছেলে সাদ এরশাদও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে ছিলেন। নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটার পর ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে। স্ত্রীর আসনে সমঝোতার বিনিময়ে জাতীয় পার্টিকে বিক্রি করে দেয়া, নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করা, দলীয় প্রার্থীদের পাশে না দাঁড়ানোর অভিযোগে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় দলীয় কার্যালয়ে।
তারপর থেকে বিক্ষোভ, বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার, গণপদত্যাগ- নানান নাটকে বিপর্যস্ত জাতীয় পার্টি। সব নাটকীয়তার অবসান হয়েছে গত ৯ মার্চ। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কাউন্সিলে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান, কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব করে জাতীয় পার্টির নতুন কমিটি হয়েছে। সম্মেলনে এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদকে (সাদ এরশাদ) দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয়।
রওশন এরশাদের অবর্তমানে তিনি দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন বলেও সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়। দলের অন্যান্য পদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশিদ নির্বাহী চেয়ারম্যান, আবু হোসেনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এছাড়াও কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন সাইদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, গোলাম সরোয়ার ও সুনীল শুভ রায়।
তবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের দাবি তারাই মূল দল। রওশন এরশাদ আরেকটি ব্র্যাকেটবন্দী জাতীয় পার্টির জন্ম দিলেন। ভবিষ্যত কী হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আপাতত এরশাদের বউয়ের চেয়ে ভাইয়ের অংশের ক্ষমতাই বেশি। জিএম কাদের সংসদে বিরোধী দলের নেতা। দলের ১১ সাংসদও তার নেতৃত্বেই আছে। লাঙ্গলও আপাতত জিএম কাদেরের কাছেই থাকলো। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। তবে জাতীয় পার্টির নাটক এখানেই শেষ নয়, এটা নিশ্চিত।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জেআইএম