আইন-আদালত

‘বেআইনি ইমারত নকশার অনুমতি কারা দেয়, চিহ্নিত করতে হবে’

অগ্নিনির্বাপণ ও অন্যান্য সুবিধা ছাড়া বেআইনিভাবে যারা ইমারত গড়েছে, নকশা করেছে, সেটার মনিটরিং নেই, তাদের চিহ্নিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ।

Advertisement

তিনি বলেন, একটি ইমারত তৈরি করতে হলে রাজউকের অনুমতি লাগে। এই অনুমতি কারা দেয় এবং কারা এটি মনিটরিং করে এগুলো চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন।

আপিল বিভাগের এই বিচারক আরও বলেন, আমি যখন দেখবো লাল দাগ, বড় সাইনবোর্ড, অগ্নিনির্বাপণের পযার্প্ত ব্যবস্থা নেই আমরা সেখানে যাবো না। বেইলি রোডে আগুন লাগার ঘটনার আগে এ বিষয়ে জানলে অসহায় ছেলেমেয়েগুলো নিয়ে সেখানে কেউ যেত না। আমরা তাদের রক্ষা করতে পারিনি।

তিনি বলেন, আমিও এই সমাজেরই মানুষ। আমরা যারা বেঁচে আছি, যারা জীবিত প্রত্যেকেরই এই দায়ভার নিতে হবে, দায়ভার আমারও।

Advertisement

এ সময় আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবেগাপ্লুত হয়ে যান। তিনি বলেন, আমার খুব কষ্ট লাগে। আমরা জানি না সেখানে গেলে জীবন শেষ হয়ে যাবে। এখানে অনেক ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত আছেন, তারা জানেন তাদের বেদনার কথা।

শনিবার (৯ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নিমতলী থেকে বেইলি রোড: অগ্নিকাণ্ডের বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

নিমতলী থেকে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের মতো যত ঘটনা আছে সেগুলোর পরে অবহেলাজনিত মৃত্যুর কারণে মামলা করা হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে অবহেলাজনিত মৃত্যুর মামলা না করে বেআইনি কার্যকলাপের মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি।

তিনি বলেন, নিমতলী থেকে বেইলি রোডে আগুন লাগার পেছনে অবহেলা জড়িত নয়। এটির সঙ্গে বেআইনি কার্যকলাপ জড়িত। অবহেলাজনিত কারণে মামলা করে সময় নষ্ট করার সময় বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। বেআইনি কার্যকলাপের জন্য মামলা করতে হবে। যে মামলার মাধ্যমে দণ্ড হবে, অর্থদণ্ড হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে এমন মামলা করতে হবে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ইমারতজনিত কারণেই হয়েছে।

মতবিনিময় সভায় এসব অগ্নিকাণ্ডের কারণ, আগুন লাগার পরের অবস্থা ও তদারকি সংস্থাগুলোর করণীয় এবং সীমাবদ্ধতা নিয়েও আলোচনা করেন বক্তারা। এসময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেন নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব।

তিনি বলেন, এই নগরীর সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্বের কারণ কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা ও পুঞ্জিভূত সম্পদ। ফলে বিশৃঙ্খলভাবে পুরো নগরী অতিজনঘনত্বের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এমন ঘনবসতিপূর্ণ নগরে ফায়ার ব্রিগেডে আগুন নেভানোর জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র আনা হয়েছে। অথচ এই সংস্থা ইন্সপেক্টরদের মাত্র ৪৬ শতাংশ পদায়ন আছে। বাদ-বাকি পদায়নের জন্য আবেদন করলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বছরের পর বছর সেটি ঝুলিয়ে রেখেছে। মাত্র ৪৬ শতাংশ মানুষ নিয়ে পুরো নগরী কি সুরক্ষিত হবে?

ভবন মালিক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কেউই আইন মানে না বলে মন্তব্য করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক প্রকৌশলী ফরিদ আহম্মদ। তিনি বলেন, চুড়িহাট্টা থেকে বেইলি রোড পর্যন্ত যতগুলো অগ্নিকাণ্ড হয়েছে আমরাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নিয়ে সেগুলোর তদন্ত করেছি। তদন্তের উদ্দেশ্য ছিল এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করা। ঢাকা শহরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমাদের সবকিছুর আইন আছে কিন্তু সেটি মানুষ মানছে না।

এসব ঘটনার আগে ও পরে আদালত বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। তবে এসব নির্দেশনা কেউই মানে না বলে আক্ষেপ জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, দোষীরা আদালতের নির্দেশ কোনোভাবেই মেনে চলে না। আদালত বারবার বলেছেন বেইলি রোডের আগে যে অগ্নিকাণ্ডগুলো হয়েছে তখন সরকার যে কমিটি গঠন করেছে সেই রিপোর্টগুলো আদালতের সামনে জমা দেওয়া হয়নি। যখন চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তখন অনেকগুলো ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিয়েছিল। চুড়িহাট্টার একটা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার আজ পর্যন্ত সেই ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি। কিন্তু সেই ব্যাংকগুলোর অফিসিয়াল সাইটে উল্লেখ করা আছে তারা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা জমা দিয়েছে।

নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে ঢাকা সিভিল ডিফেন্স এবং ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক বলেন, বাংলাদেশে যখন মহুকুমা ছিল তখন যে পরিমাণ জনবল ছিল আমরা এখনো সেই জনবল নিয়ে চলছি। যার কারণে আমাদের জনবলের অনেক অভাব রয়েছে। যখন কোনো ভবনে আগুন লাগে তখন উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে আমাদের কাজ করতে অসুবিধা হয়। ঢাকায় ওয়াসার যতগুলো পাম্প হাউজ আছে, সেগুলোতে যদি একটি অথবা দুইটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা হয় তাহলে আমদের জন্য আগুন নেভানোর কাজ অনেক সহজ হয়।

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, ১১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এবং জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৭৫ জন।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম-এসএনএফ, সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) যৌথভাবে আয়োজন করেছে এ সভার।

অনুষ্ঠানে ব্লাস্ট অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদাও বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড আ্যান্ড সার্ভিসেস (ব্লাস্ট)-এর আইনবিষয়ক পরিচালক মো. বরকত আলী। এসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের পরে অধিকারভিত্তিক সংগঠনগুলোর করা মামলায় বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন বেলা ও ব্লাস্টের আইনজীবীরা।

এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম