সাহিত্য

এই নগরেই কোনো চায়ের আড্ডায় ইকবাল আজিজ লুকিয়ে আছেন

ঢাকা শহরের এক নিভৃতচারী কবি ইকবাল আজিজ। আমার সাথে একসময় দারুণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমি তখন নগর গবেষণা কেন্দ্রে প্রফেসর নজরুল ইসলামের অধীনে গবেষণার নামে ফাঁকিবাজি করি। নজরুল স্যারের সাথে আড্ডায় কথায় কথায় একদিন কবি ইকবাল আজিজের কথা তুললাম।

Advertisement

নজরুল স্যার নগর গবেষণা ও পরিকল্পনাবিদ হলেও শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র ভীষণভাবে পছন্দ করেন। একজন নিপুন আর্ট কালেক্টর নজরুল স্যারকে একদিন কবি ইকবাল আজিজের জন্য একটা স্কলারশিপের প্রস্তাব করলাম। নজরুল স্যার প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেন। পরদিন অফিসে এসে আমাকে ডেকে বললেন, নগর নিয়ে গবেষণাধর্মী একটা কবিতার বই প্রকাশ করার তোমার আইডিয়াটা কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে। ডাকো তোমার কবিকে।

কবি ইকবাল আজিজকে টেলিফোনে একদিন বিকেলে নগর গবেষণা কেন্দ্রে ডাকলাম। নজরুল স্যার কবি ইকবাল আজিজের সাথে কফি খেয়ে আড্ডা দিলেন। তারপর বললেন, আপনি নগর বিষয়ক কবিতা নিয়ে কাজ করতে চান। বেশ ভালো কথা। কিন্তু আপনাকে তিন মাসের বেশি আমি পয়সা দিতে পারব না। তিন মাসে পারবেন তো শেষ করতে। কবি ইকবাল আজিজকে আমি চোখ মারলাম। তার মানে আগে কাজ শুরু করুন। পরে যা করার দেখা যাবে।

তারপর থেকে কবি ইকবাল আজিজের নগর কবিতা নিয়ে গবেষণা যজ্ঞ শুরু হলো নগর গবেষণা কেন্দ্রে। কিন্তু ধীরে ধীরে কবি ইকবাল আজিজের গবেষণার চেয়ে আমার সাথে আড্ডা আর চা খাওয়ার ব্যাপারটা অফিসের সবার কাছে দৃষ্টিকটু হতে শুরু করলো। কিন্তু ওসব নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই।

Advertisement

কারণ স্বয়ং নজরুল স্যার আমাদের দারুণভাবেই প্রশ্রয় দেন। আমি অফিসের কম্পিউটারে তাস খেলি। আর কবি ইকবাল আজিজ নগর বিষয়ক নানান কিসিমের কবিতা আমাকে পড়ে শোনান। কোন কবিতা নিয়ে কী কী লিখেছেন, কী কী নোট করলেন, তা পড়ে শোনান। দিনে দিনে আমাদের সখ্যতা বাড়ে।

একবার আমরা তখন কবি শামসুর রাহমান আর ডক্টর হুমায়ুন আজাদ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পরি। আমাদের সাথে তখন কাজ করে জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের সাদিয়া বা সোনিয়া (এই মুহূর্তে সঠিক নামটি মনে পড়ছে না, পরে সে বিসিএস ক্যাডার হয়ে চলে যায়)।

আমাদের যুদ্ধ বন্ধে সাদিয়া একটা প্রস্তাব করলো। তার নামে আমাদের যে একটা ভালো কবিতা লিখতে পারবে তাকে সে বিশেষ উপহার দেবে। আমি তাস খেলেই যাচ্ছি। ওদিকে কবি ইকবাল আজিজের সাদিয়াকে নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা লেখা শেষ। সাদিয়া কবিতাটি দারুণ পছন্দ করেছে। মোস্তাফিজ কবিতাটা কম্পিউটারে টাইপ করে পিন্ট করে সাদিয়াকে দিয়েছে। তারপর আমরা সবাই মিলে শংকরের একটি হোটেলে ভুরিভোজ করি।

তারপর শুরু হলো আমাদের ভুরিভোজনে নতুন নতুন ক্যারিশমা। আমার অধীনে তখন কাজ করতো আসাদ। আসাদ আমারে গুরু ডাকে। আসাদের কাজ হলো রোজ দুপুরে কোথায় ভালো লাঞ্চ করা যাবে সেসব অজানা তথ্য সরবরাহ করা। ব্যাস, আমরা দলবেধে চলে যাই লাঞ্চ করতে। আমাদের খাওয়া দাওয়া আড্ডা সবই চলে কিন্তু গবেষণায় ঠনঠনাঠন!

Advertisement

একদিন নজরুল স্যার কবি ইকবাল আজিজকে ডাকলেন। নগর বিষয়ক কবিতা গবেষণার হালচাল জিজ্ঞেস করলেন। আর বললেন, ছয় মাসে শেষ করুন। পরে মহা ধুমধামে আমরা নজরুল স্যারের জন্মদিন পালন করলাম। অতপর একদিন কবি ইকবাল আজিজের নগর কবিতা বিষয়ক গবেষণার বই 'বাংলাদেশের কবিতার নগর' প্রকাশ পেল। প্রকাশক নগর গবেষণা কেন্দ্র। বইয়ের প্রথম কপি সাদিয়াকে দেওয়ার পর কবি ইকবাল আজিজের সাথে আমার সেই চিরাচরিত তর্কযুদ্ধ।

কবি ইকবাল আজিজ স্নেহ করে আমাকে ডাকতেন ঘোটক। আহা সেই আড্ডার দিনগুলো কত মিষ্টি ছিল। করোনা মহামারীর মধ্যে কবি ইকবাল আজিজ একরাতে আমাকে ফোন করলেন। বললেন, লেখকদের টেলিফোন নম্বর নিয়ে লোকের অনিকেত শামীম একটা ডায়েরি বের করেছে, ওখানে তোমার ফোন নম্বর পেলাম। আমি যথারীতি হুংকার দিলাম, আমার নম্বর আপনি হারায়ে ফেলছেন কবি! জবাবে কবি ইকবাল আজিজ বললেন, ফোন হারাই সবার নম্বর হারাইছি।

কবি ইকবাল আজিজ কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। মাঝে মধ্যে আজিজে দেখা হলে বেশ আড্ডা জমতো আমাদের। কবি সমুদ্র গুপ্ত আমাকে ডাকতেন মামু। আর আমি তাকে ডাকতাম সাদা ভাল্লুক। তো আজিজে একদিন কবি ইকবাল আজিজ আর আমি যুদ্ধ শুরু করেছি। পরে কবি সমুদ্র গুপ্ত চা খাইয়ে আমাদের শান্ত করলেন।

কবি ইকবাল আজিজ রেগে গেলে খুব তোতলাতেন। তখন আর কথা বলতে পারতেন না। আমি সেই সুযোগে কবি ইকবাল আজিজকে অনেক কথা শুনিয়ে দিতাম। একদিন পড়ুয়ার কাজলদা আমাদের যুদ্ধ থামাতে চা খাওয়ালেন। চা খেলেই আমাদের যুদ্ধ থেমে যেত। ঢাকায় কবিদের মধ্যে যাদের সাথে আমার সখ্যতা, কবি ইকবাল আজিজ তাদের মধ্যে অন্যতম। একেবারে পেটের খবর বের করার মত সুসম্পর্ক যাকে বলে আর কি!

আমার মা মারা গেছে, সেই খবর শুনে শনির আকড়া থেকে কবি ইকবাল আজিজ আমাকে শান্তনা দিতে আসেন বাংলা একাডেমিতে। এক অমানুষের ছায়া, অন্তহীন সৌরঝড়, কীভাবে শরীর বৃক্ষ হয়ে যায়, ফিরে আসে প্রাচীন পুরুষ, বাংলাদেশের কবিতায় নগর, প্রতীকের হাত ধরে অনেক প্রতীক, লিখে রাখো আমার এ স্বীকারোক্তি, এক চাকরের সান্ধ্যগীতি, এই সময়ের সেরা গল্প, শ্রেষ্ঠ কবিতা, নির্বাচিত কবিতা, নির্বাচিত প্রবন্ধ ও অন্যান্য ইত্যাদি বইয়ের ভেতরে এই নগরেই কোনো চায়ের আড্ডায় কবি ইকবাল আজিজ লুকিয়ে আছেন। কবি ইকবাল আজিজ চলে গেছেন একথা আমি বিশ্বাস করি না।

লেখক: কবি, চলচ্চিত্র পরিচালক।

এইচআর/জেআইএম