দেশজুড়ে

‘নিজেকে একা মনে হলেও কখনো অনিরাপদ মনে হয়নি’

আমিনা বিলকিস ময়না। সাতক্ষীরার একজন টিভি সাংবাদিক। পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় কাজে কোনো অংশে কম নন তিনি। পেশাগত দায়িত্ব পালনে ছুটে বেড়ান উপকূলের প্রত্যন্ত জনপদে। বের করে আনেন উপকূলের বাঁধভাঙা মানুষের দুঃখ-দুর্দশার গল্প। সুন্দরবন, নদী-সাগরের খবর ঘটনাস্থল থেকে তুলে ধরছেন নিয়মিত। প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরতেও পিছপা হননি কখনো। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে আমিনা বিলকিসের সংগ্রামী জীবনের গল্প।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনি সাতক্ষীরার মতো মফস্বল জেলা থেকে কীভাবে সাংবাদিকতায় এলেন?

আমিনা বিলকিস: আমি সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হই। সাতক্ষীরায় সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী গড়ে তুলতে আমার ভূমিকা রয়েছে। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে অনার্স পড়ার সময় প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ গড়ে তুলি। আমি যখন ছাত্রী, তখন থেকেই সাতক্ষীরার স্থানীয় সংবাদপত্র ‘দৈনিক কাফেলা’য় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। পরবর্তী সময়ে ওই পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে চাকরি নিই। পেশাদার সাংবাদিকতার শুরুটা তখন থেকেই।

জাগো নিউজ: পড়াশোনা শেষে অনেকে ভিন্ন ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেন। আপনি সাংবাদিকতায় এলেন কেন? একজন নারী পেশা হিসেবে যদি বেছে নেন সাংবাদিকতা, সেই নারীর চ্যালেঞ্জ কতটা?

Advertisement

আমিনা বিলকিস: নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই রয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক চাপের মধ্যে থেকে সাংবাদিকতার মতো পেশায় আসাটা অনেক কঠিন।এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা মফস্বলের সামাজিক ব্যবস্থা। এখানে নারীকে সবসময় ভিন্ন চোখে দেখা হয়। তারপরও আমার মতো অনেক নারী বর্তমানে এই পেশায় আসছেন। হঠাৎ ইচ্ছা হলেই সাংবাদিকতায় আসা যায় না। অন্যদের মতো ভিন্ন পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন আমারও ছিল। কিন্তু সব শ্রেণির মানুষের কাছে থাকার জন্য সাংবাদিকতা পেশার বিকল্প কিছু নেই। এজন্যই সাংবাকিতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি।

জাগো নিউজ: সাংবাদিকতা মানেই নিরাপত্তাহীন পেশা। এখানে আর্থিক নিশ্চয়তাও নেই। নারীদের জন্য কি পেশাটা নিরাপদ? আপনি কী মনে করেন?

আমিনা বিলকিস: সাংবাদিকতার শুরুর দিকে কোনো বেতন পেতাম না। তখন আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনে চাকরি করতাম। সেখানে অ্যাকাউন্টসসহ অ্যাডমিন অফিসার পদে কাজ করেছি। পরে সেখান থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. আইনুন নিশাতের অধীনে সিথ্রিইআর (সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ) প্রকল্পে গবেষণা সহকারী হিসেবে যুক্ত হই। ড. আমিনুর রহমানের অধীনে ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে যাই। জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাববিষয়ক সেমিনারে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। এরপর সেখান থেকে আমেরিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্টদূত হুমায়ুন কবিরের অধীনে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে (বিইআই) যুক্ত হই। এরমধ্যেও সাংবাদিকতা ছাড়িনি।

খুলনা থেকে প্রকাশিত আঞ্চলিক পত্রিকা ‘দৈনিক সেবক’, যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক সত্যপাঠ’, জাতীয় দৈনিক ‘অর্থনীতি প্রতিদিন’, ‘আজকের দর্পণ’, ‘বাংলাদেশ নিউজ’ পত্রিকায় পার্ট টাইম সাংবাদিকতা করতাম। এরপর বাংলা টিভিতে যোগ দেই। পরে নিউজ চ্যানেল ‘চ্যানেল টোয়েন্টিফোর’-এ চাকরি হয়। গত পাঁচ বছর ধরে সেখানেই কাজ করছি। আগের অতীত অভিজ্ঞতাগুলো বর্তমানে সাংবাদিকতায় কাজে লাগছে। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে আমি প্রতিমাসে নিয়মিত বেতন ও যাতায়াত ভাতা পাই। সাংবাদিকতা পেশায় এসে নারী হিসেবে নিজেকে একা মনে হলেও কখনো অনিরাপদ মনে হয়নি। আমার স্বামীও একজন সংবাদকর্মী। তিনিও আমাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেন।

Advertisement

জাগো নিউজ: মফস্বলে নারী সাংবাদিকদের কাজ করা কতটা চ্যালেঞ্জের? পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে কতটা সমস্যা হচ্ছে?

আমিনা বিলকিস: মফস্বলে সাংবাদিকতা বেশ কঠিন। নারী হয়ে সাংবাদিকতা পেশায় এসে সমাজের মানুষের কাছে বিভিন্ন রকম কথা শুনতে হয়েছে। পরিবারের অনেকে এটিকে ভালোভাবে নেয়নি। আমার একমাত্র সন্তান অগ্র বিসর্গ ও স্বামী শরীফুল্লাহ কায়সার সুমনের সহযোগিতা-অনুপ্রেরণা আমার পথচলাকে সহায়ক করেছে। আমি কখনো পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতার আশায় তাকিয়ে থাকিনি। তাদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছি নিজের মতো করে। লক্ষ্য একটাই, যে মানুষদের কথা কেউ তুলে ধরে না; আমি সেই বঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমার এই কাজে আমার প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীরা আছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আমি আরও সামনে এগিয়ে যেতে চাই সবার সঙ্গে সমানতালে। প্রান্তিক মানুষের জন্য সাংবাদিকতাকে আরও ধারালো করার বাসনায়।

জাগো নিউজ: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আমিনা বিলকিস: আপনাকেও ধন্যবাদ।

এসআর/জেআইএম