দুই দিনব্যাপী ভোটগ্রহণের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার অ্যাসোসিয়েশন) নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এতে হামলার ঘটনাও ঘটে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শুক্রবার দুপুরে ভোট গণনা শুরু হয়নি।
Advertisement
যারা হামলা করেছেন তারা স্বতন্ত্র সম্পাদক প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথীর সমর্থক বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হকের সমর্থকদের মারধর করা হয়। তারা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফকে বেধড়ক পেটায়। তাকে মারার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে বিরাজ করছে টান টান উত্তেজনায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার সকাল থেকে দেখা যায় ভোটের ব্যালট বাক্স সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে (অডিটোরিয়ামে) পুলিশের পাহারায় রয়েছে। এই প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ও কয়েকজন সাংবাদিক ছাড়া সরকার ও বিরোধীদলের কোনো প্রার্থী-সমর্থকদের লক্ষ্য করা যায়নি।
এর আগে বুধ ও বৃহস্পতিবার- এই দুদিন ভোটগ্রহণ হয়। সেদিনই রাতে ১১টার পর ভোট গণনার কথা ছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বাইরে সাদা পোশাক পরা লোকজন দেখে সমিতির সবগুলো গেটে তালা লাগিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। এরপর আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক কক্ষ বরাবর সরাসরি নিচের একটি গেট (মূল ভবনের গেট) খোলা রাখা হয়। যেখান দিয়ে আইনজীবীদের পরিচয়পত্র দেখে প্রবেশ করানো হচ্ছিল। এদিকে রাত থেকেই সাদা শার্ট পরা সুপ্রিম কোর্ট মাজার গেটের সামনে বটতলায় শত শত লোকের সমাগম লক্ষ্য করা যায়।
Advertisement
মধ্যরাতের পর ভোট গণনা শুরু হলে ৮ মার্চ রাতে ভোট গণনার জন্য সোচ্চার হন সম্পাদক প্রার্থী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথী। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্পাদক প্রার্থী শাহ মনজুরুল হক শুক্রবার দিনের আলোতে ভোট গণনার দাবি জানান। এ বিষয়ে একপর্যায়ে দুপক্ষের সমর্থকদের মাঝে কথা কাটাকাটি হট্টগোল শুরু হয়। সেই ঘটনা রূপ নেয় মারামারিতে। সেখানে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী আহত হন।
এসব ঘটনার একপর্যায়ে গণনা ছাড়াই, শুক্রবার সকালে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবুল খায়ের ১৪ পদের মধ্যে শুধু একজনের ফলাফল ঘোষণা করেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক প্রার্থীরা অনুপস্থিত থাকায় একজন প্রার্থীর উপস্থিতিতে রয়েছেন বলে তাকে বিজয় ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র নাহিদ সুলতানা যুথী সম্পাদক প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন, তাই তাকে সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো।’
নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত এক আইনজীবী জাগো নিউজকে বলেন, ভোরের দিকে ফজর নামাজের পর আওয়ামী লীগ সমর্থক সাদা প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। কিছু বহিরাগতরা বারে প্রবেশ করে আইনজীবীদের মারধর করে। এসময় চাপের মুখে সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথীকে জয়ী ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
Advertisement
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে সরকার সমর্থক আইনজীবী ও সরকার সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে।
ভোটের ফলাফলের বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে সাদা প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী শাহ মনজুরুল হক ‘সকাল ৮টার পর পুলিশের পাহারায় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ছেড়ে বাসায় চলে যান।’
অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল শুক্রবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ভোটের পর আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলাম। এখনো আমরা ফলাফলের অপেক্ষায় আছি। আমরা এখন ব্যালট বাক্সও খুঁজে পাচ্ছি না, নির্বাচন কমিশনকেও খুজে পাচ্ছি না।’
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী সমিতির এই নির্বাচনে ১৪ জনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি, দুজন সহ-সভাপতি, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, দুজন সহ-সম্পাদক এবং সাতজন সদস্য নির্বাচিত হবেন। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ৭ হাজার ৮৮৩ জন। আর প্রার্থী ৩৩।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ (সাদা প্যানেল) থেকে সভাপতি পদে আবু সাঈদ সাগর, সম্পাদক পদে শাহ মঞ্জুরুল হক, সহ-সভাপতি পদে রমজান আলী শিকদার ও দেওয়ান মো. আবু ওবাঈদ হোসেন সেতু, কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ নুরুল হুদা আনসারী, সহ-সম্পাদকের দুটি পদে মো. হুমায়ুন কবির ও মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির প্রার্থী হয়েছেন।
এছাড়া সাতটি সদস্য পদে মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান ভূইয়া, মাহমুদা আফরোজ, মো. বেলাল হোসেন, খালেদ মোশাররফ, মো. রায়হান রনি, সৌমিত্র সরদার ও রাশেদুল হক খোকন প্রার্থী হন।
অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল প্যানেল) থেকে সভাপতি পদে ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন (খোকন), সম্পাদক পদে ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস, সহ-সভাপতি পদে মো. হুমায়ুন কবির ও সরকার তাহমিনা বেগম, কোষাধ্যক্ষ পদে মো. রেজাউল করিম, সহ-সম্পাদক পদে মাহফুজুর রহমান ও মো. আবদুল করিম প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া সাতটি সদস্য পদে ফাতিমা আক্তার, সৈয়দ ফজলে এলাহী, মো. শফিকুল ইসলাম শফিক, মো. রাসেল আহমেদ, মো. আশিকুজ্জামান নজরুল, মহিউদ্দিন হানিফ ও মো. ইব্রাহিম খলিল প্রার্থী হন।
সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে এবার সভাপতি পদে প্রার্থী হন অ্যাডভোকেট মো. ইউনুছ আলী আকন্দ ও অ্যাডভোকেট মো. খলিলুর রহমান বাবলু (এম কে রহমান)। সম্পাদক পদে প্রার্থী হন অ্যাডভোকেট ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূইয়া ও অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথী। আর কোষাধ্যক্ষ পদে প্রার্থী হন মো. সাইফুল ইসলাম।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৩-২৪ নির্বাচনে ভাঙচুর, সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা ও হট্টগোলের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ভোট বর্জন ও নতুন নির্বাচনের দাবির মধ্যেই ১৭ মার্চ রাতে সে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। যেখানে সভাপতি-সম্পাদকসহ ১৪টি পদের সব কটিতেই জয় পান আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেলের আইনজীবীরা।
এফএইচ/জেডএইচ/এমএস