ঘটনাটি ২০১৮ সালের। পারিবারিক কাজে ব্যাংকে গিয়েছিলেন খাদিজা। ব্যাংকে সিরিয়াল নিয়ে বসে ছিলেন সোফায়। হঠাৎ চোখ আটকে যায় রাস্তার বিপরীতে থাকা একটি প্রযুক্তি কোম্পানির নামফলকে। কাজ শেষ করে কৌতুহলবশত সেখানে গিয়ে জানতে পারেন ঘরে বসে আয়ের সুযোগ সম্পর্কে। জানলেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা বিষয়। সেই ক্রিয়েটিভ আইটির সাইনবোর্ডটিই খাদিজার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
Advertisement
চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের মেয়ে শেখ খাদিজা খানম। উপজেলার মধ্যম মায়ানী গ্রামের হামিদ মুহুরী বাড়িতে বেড়ে ওঠেন তিনি। আবুতোরাব ফাজিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক শেখ মাওলানা মহিউদ্দিনের ৮ সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। মধ্যম মায়ানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং নিজামপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে বাংলায় স্নাতক করছেন দেশসেরা ফ্রিল্যান্সার শেখ খাদিজা খানম। শ্বশুরবাড়ি একই উপজেলার মিঠানালা গ্রামে।
শেখ খাদিজা খানমের মাসে আয় হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। অনলাইন ফ্রিল্যান্স মার্কেট প্লেসে কাজ শুরু করে তিনি সফল হয়েছেন। ২০২৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে দেশসেরা ১৫ ফ্রিল্যান্সারকে সম্মাননা দেওয়া হয়। এতে চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হওয়া একমাত্র ফ্রিল্যান্সার খাদিজা। প্রথমদিকে কোর্সে খাদিজা কিছুই বুঝতেন না। তবুও হাল ছাড়েননি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খাদিজা এখন দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারদের একজন।
শেখ খাদিজা খানম মূলত একজন গৃহিণী। চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার এলাকায় তিন ছেলে আর স্বামী নিয়ে থাকেন ভাড়া বাসায়। পুরো দিন কাটে সংসারের কাজের ব্যস্ততায়। সন্ধ্যা গড়াতেই তিনি হয়ে যান একজন মুক্ত পেশাজীবী। তৈরি করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন।
Advertisement
২০২০ সালের করোনাকাল খাদিজার জন্য যেন আশীর্বাদ বয়ে আনে। ছেলেদের স্কুল বন্ধ। অনেকটা সময় ফ্রিল্যান্সিংয়ে দিতে পেরেছেন। লিংকডিন নিয়ে কাজ করে ঘণ্টায় আট ডলার করে আয় করেন। সর্বমোট ৩০০ ডলারের কাজ করেন তিনি। সেটাই ছিল তার প্রথম আয়। ওই সময়ে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এলইডিপি) একটি বেসিক কোর্সও সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
বর্তমানে তিনি ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে আয় করেন। ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, ক্যানভা প্রোর কাজ ভালোই পারেন খাদিজা। আবার ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সোশ্যাল মিডিয়া, যেমন ফেসবুক, লিংকডিন, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, কোরা, রেডিট, ইউটিউব, পিন্টারেস্ট ইত্যাদি পেইড মার্কেটিংয়েও তার জুড়ি নেই।
ভিডিও এডিটিংয়ের মধ্যে সোশ্যাল রিল এবং ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার-আপটার ইফেক্ট, প্রিমিয়ার প্রো, ডা-ভিঞ্চি রিসলভে তার দক্ষতা রয়েছে। খাদিজা এ পর্যন্ত ৪০ জন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। এবার নারী দিবসে পেয়েছেন জয়িতার পুরস্কার। খাদিজার তিন ছেলে। বড় ছেলে কাজী হাসান আবদুল্লাহ উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র। মেজ ছেলে কাজী আবদুর রহমান অষ্টম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে কাজী আজহারুল ইসলাম চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। মায়ের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং শিখছেন কাজী হাসান আবদুল্লাহ ও কাজী আবদুর রহমান।
বর্তমানে খাদিজা আপওয়ার্কে সেরা ৩ ফ্রিল্যান্সারদের একজন। স্ত্রীর কাজে শুরু থেকেই পাশে থেকেছেন স্বামী কাজী আবুল হোসেন। স্ত্রীর কাজের সময় ছেলেদের স্কুলে নেওয়া, খাওয়া দাওয়া, সংসারের কাজ সবটা তিনি করেন। খাদিজার কোর্স করা, পিসি কেনা, ছোট বড় সব ধরনের জোরালো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন স্বামী কাজী আবুল হোসেন।
Advertisement
দেশসেরা ফ্রিল্যান্সার শেখ খাদিজা খানম বলেন, আমার স্বামীর আন্তরিক অনবদ্য অবদান, ত্যাগ, পরিশ্রম এবং একনিষ্ঠ সহযোগিতা আমার এতদূর আসার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। আমার একান্ত ইচ্ছা পরিবারের নারী সদস্য যারা সংসারে অবহেলিত জীবন কাটান, কাজ শিখিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। নিজের সন্তানদের পড়াশোনা এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি আইটিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে চাই এবং ওদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই।
মিরসরাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহের আফরোজ বলেন, খাদিজা মিরসরাইয়ের গৌরব, দেশের গৌরব। তার কাছ থেকে অন্য নারীরা অনুপ্রেরণা পাবেন। আমরা এবার নারী দিবসে তাকে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত করেছি।
এফএ/জিকেএস