খেলাধুলা

দাবার রানির চোখে নারী ক্রীড়াবিদদের সেকাল-একাল

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ৮১ বছরে পা দিয়েছেন। এ বয়সেও দিব্বি খেলে যাচ্ছেন রানী হামিদ। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি বেশি পরিচিত দাবার রানি হিসেবে। ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টারের খেতাব অর্জন করেছেন রানী হামিদ। বাংলাদেশের প্রথম নারী দাবাড়ু হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন এই খেতাব। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা মিলে ২৫টি ব্যক্তিগত শিরোপা আছে তার।

Advertisement

দাবার বোর্ডের সঙ্গে রানী হামিদের সখ্যতা ১৯৭৭ সাল থেকে। বিগত ৪৭ বছরেও সে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। তিনিই এখন দেশের সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক তার। নিজে দাবা খেলছেন। তার স্বামী প্রয়াত কর্নেল আবদুল হামিদ ছিলেন দেশের স্বনামধন্য ক্রীড়া সংগঠক। ছেলে কায়সার হামিদ জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার। অন্য দুই ছেলের মধ্যে সোহেল হামিদ খেলতেন স্কোয়াশ এবং শাহজাহান হামিদ ববি খেলতে হ্যান্ডবল। এককথায় ক্রীড়া পরিবারের সদস্য তিনি।

দাবার রানীর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিচরণ দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে। ওই সময় একজন নারী হিসেবে তার খেলাধুলায় আসা, দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া এবং বর্তমান যুগে ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের পথ চলার নানা প্রতিকূলতা, প্রতিকূলতা এড়িয়ে সফল হওয়ার কৌশল, নিজেকে নিরাপদ রাখতে কী করণীয় সবকিছু নিয়ে কথা বলেছেন। রানী হামিদ তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে মূল্যায়ন করেছেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে কিভাবে নারীদের পদচারণা বেড়েছে। সেকাল আর একালের মধ্যে পার্থক্যও খুঁজে বের করেছেন দাবার এই কিংবদন্তি।

রানী হামিদরা যখন খেলাধুলা শুরু করেছিলেন, তখন আর এখনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখেছেন দেশের বর্ষীয়ান এই ক্রীড়াবিদ। বিশেষ করে অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন, প্রতিবন্ধকতা, খেলোয়াড়দের আর্থিক স্বচ্ছলতা, মেয়েদের নিরাপদ পরিবেশ সর্বোপরি সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। সব দিক দিয়ে বিবেচনায় ওই সময়ের সঙ্গে এখনকার কোনো কিছুর তুলনাই হয় না।

Advertisement

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রানী হামিদ বলেন, ‘আমি খেলাধুলা করি স্কুল জীবন থেকে। ১৯৫৫ সালে আমি তখন কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আমার দৌড় দেখে স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক বলেছিলেন পাকিস্তান অলিম্পিকে পাঠাবেন। তবে করাচিতে যাওয়া লাগবে বলে বাবা রাজি হননি। ছেলে হলে হয়তো ওই সময় বাবা আমাকে যেতে দিতেন। মেয়ে হওয়ার কারণে ওই প্রতিবন্ধকতায় পড়েছিলাম। এখন সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যদিও অভিভাবকরা পুরোপুরি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন না। দাবায় অনেক মেয়েরা খেলে। দেখি মায়েরা বসে থাকেন। অভিভাবকরা মেয়েদের পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবেন সে অবস্থা এখনো আসেনি।’

অনেকেই বলেন, ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। এখনো মাঝেমধ্যে মেয়েদের হয়রানি হওয়ার খবর আসে। আপনি কি মনে করেন, এসব কারণে অভিভাবকরা আতঙ্কে থাকেন?

রানী হামিদ বলেন, ‘আসলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা সবদেশেই হয়। আবার কেবল ক্রীড়াঙ্গনেই নয়, সব সেক্টরেই হয়ে থাকে। আমি মনে করি, নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটাই নিজের ওপর নির্ভর করে। নিজে সচেতন থাকলে বিপদ কম হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে। উদাহরণ হিসেব বলবো-একজন নারী ক্রীড়াবিদ যদি অহেতুক বিলম্ব করে ঘরে ফেরে এবং পথে সন্ধ্যা নেমে আসে তাহলে তার বিপদে পড়ার শঙ্কা থাকতে পারে। এ সব বিষয়ে নিজেকে সচেতন রাখতে হবে।’

‘আরেকটি বিষয় হলো শালীনতা। একজন মেয়ের শালীনতার ওপরও নির্ভর করে তার সমস্যায় পড়ার শঙ্কা কতটুকু। আমি ৫০ বছর ধরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আছি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন নারীর চলাফেরা, আচার-আচরণের ওপর নির্ভর করে সে নিজে কতটা নিরাপদ থাকতে চায়। আরেকটি বিষয় হলো শৃঙ্খলা ও পারিবারিক শিক্ষা। আমার নিজের কথা বলি, খেলাধুলা শেষ করে সময়মতো বাসায় ফিরতে সব সময় নির্দেশ থাকতো বাবা-মায়ের। বাসায় ঢোকার পরই আমাদের লেখাপড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হতো। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষাও মেয়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’

Advertisement

এখন খেলাধুলায় মেয়েরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পায় উল্লেখ করে বর্ষীয়ান এই ক্রীড়াবিদ বলেন, ‘দাবার কথাই বলি, আমরা তখন একটা বই পড়ার সুযোগও পেতাম না। এখন কত ধরনের প্রযুক্তি। আমাদের সময় তো এত সুযোগ ছিল না। এখন মেয়েরা সফলতাও আনছে। এই যেমন ফুটবলে আমাদের মেয়েরা ভালো করছে। অনেক ট্রফি এনেছে। ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলাতেও এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা।’

‘খেলাধুলার মাধ্যমে মেয়েরা উপার্জন করে। এখানে আমি পুরো কৃতিত্ব দেবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনে যে যখন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সফলতা এনেছে তাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার দুই ছেলের অসুস্থতায় তিনি আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। আমি আমার ছেলেরা খেলোয়াড় বলেই কিন্তু এই সম্মান পেয়েছি। খেলোয়াড় না হলে এই সম্মান পেতাম না।’

প্রায় ৫০ বছর ধরে খেলছেন। ৮১-তে পা দিয়ে কি ক্যারিয়ার নিয়ে কি ভাবছেন? আর কতদিন খেলা চালিয়ে যেতে চান? ‘আসলে দাবা হলো মাথার (বুদ্ধির) খেলা। যতদিন মাথা চলে ততোদিন আমার দাবাও চলবে। আমার ক্যারিয়ারে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি শৃঙ্খলায়। দেশের নারী ক্রীড়াবিদদের প্রতি আমার একটাই বার্তা থাকবে-ভালো ক্যারিয়ার গড়তে এবং নিজেকে নিরাপদ রাখতে শৃঙ্খলায় গুরুত্ব দিতে হবে। সচেতন থাকতে হবে’-বলেছেন ২০১৭ সালে কমনওয়েলথ দাবায় স্বর্ণ জেতা এই দাবাড়ু।

মেয়েদের খেলাধুলার অগ্রগতির পেছনে সার্ভিসেস সংস্থাগুলোর ভূমিকারও প্রশংসা করেছেন ব্রিটিশ দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া রানী হামিদ, ‘এখন বাহিনীগুলো মেয়েদের খেলাধুলায় অনেক পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এই যেমন দাবায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ ও বাংলাদেশ আনসার এগিয়ে এসেছেন। অন্যান্য খেলায় সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবির ভূমিকা আছে। আমার প্রত্যাশা থাকবে ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেয়েরা আরো এগিয়ে যাবে।’

আরআই/এমএমআর/জিকেএস