নারী দিবস আর স্বাধীনতা দিবস একই মাসে আসলেও “নারী” আর “স্বাধীনতা” এই দুই শব্দের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী বললেও ভুল হবে না। যেন নারীর সাথে স্বাধীনতার আড়ি। কর্মে তো বটেই, তবে মানসিকতায় স্বাধীনতাহরণের গোড়াপত্তন হয়ে চলেছে দিনের পর দিন ধরে।যেটার দিকে পুরুষ তো দূরে থাক, খোদ নারীদেরও যে মাথা ব্যথা নেই সেটা হলফ করে বলা যেতেই পারে। আগেই বলে রাখি নারী বলতে আমি এখানে সমাজের সকল নারী নয় তবে সমাজের বড় একটা অংশকে বোঝাচ্ছি।
Advertisement
একবিংশ শতাব্দীতে সমাজ যে ব্যাপক গতিতে এগিয়ে চলেছে সেটা দৃশ্যমান। নারীরাও তাদের কর্মে তাদের অবদান রেখে চলেছে নিরন্তর। তবে এই এগিয়ে চলাটা সমাজের কিছু নির্দিষ্ট গন্ডীর নারীদের ক্ষেত্রে সত্য। সমাজের উন্নতির শিখরে উঠতে অবদান রাখতে পারা শুধু সেই সকল নারীদের ক্ষেত্রে সত্য। এই সত্যের বাইরে যেসকল নারীরা অবস্থান করছে, তারা এখনো বিংশ শতাব্দীতেই পড়ে আছে। কর্মক্ষেত্রের উন্নতির ছোঁয়া তাদের লাগেনি, মানসিক উন্নতির বাধার কারণে। সেটা পুরুষ কিংবা নারী সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো। তথ্য উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে সফল। কিন্তু তাঁর চূড়ান্ত উদ্দেশ্যে সফল হওয়ার জন্য পৃথিবীতে তাঁর আরেকটু সময় দরকার ছিল। শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে তিনি মূলত নারীদের মুক্তি, নারী চিন্তার মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন। যেটা শুধুমাত্র শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সার্থক হয়নি।
বিবিএসের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে- ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ৭২.৮২ শতাংশ। যেখানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৫-৩৮ শতাংশ।
Advertisement
বলা হচ্ছে, ১৯৭৪ সালে সদ্যস্বাধীন দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান ছিল শতকরা মাত্র ৪ ভাগ। এই হার ১৯৮০ সালের দিকে কিঞ্চিৎ বেড়ে শতকরা ৮ ভাগে আসে। ২০০০ সালে এটি বেড়ে হয় ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সেটি ২০১০ সালে বেড়ে হয়েছে শতকরা ৩৬ ভাগ এবং বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১৩ বছরে বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ।বিবিএসের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে- ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ৭২.৮২ শতাংশ। নারী শিক্ষার হার আর কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এর হারের মধ্যে যেই বিস্তর ব্যবধান সেটাই আজকে এই লেখার আলোচ্য বিষয়। বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।- কাজী নজরুল ইসলামের এই কথাটা সমাজের নারী ও পুরুষের অবদানের সমতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য মাফিক বাংলাদেশের জিডিপির তথ্য বিশ্লেষণ করলে অবশ্য সেটাকেই বাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু এই বাস্তবতা মুহূর্তের মধ্যে ফিকে হয়ে যায় যখন চোখে পড়ে যায়-আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের প্রতিবেদনের একটি তথ্যে। সেই তথ্য বলছে -
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তিতে ৪ কোটি ২২ লাখ পুরুষ আর নারী ১ কোটি ৮৭ লাখ। তবে শ্রমিক পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণের হার সীমিত। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে আছেন মাত্র ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। উপসচিব ও সচিব পর্যায়ে এ হার ১ শতাংশ বা তারও কম। এই ভয়াবহ বৈষম্যের নেপথ্যের কারণ?
এখানে যেই কারণগুলো লিপিবদ্ধ করব, সেটা আমার মনগড়া কথা, বা চিরাচরিত গদবাধা কথা না। এই লেখার পূর্বে মোটামুটিভাবে ২০/৩০ জন প্রতিষ্ঠিত কর্মজীবী এবং শিক্ষীত গৃহিণীদের সাথে কথা বলে তাদের কথাগুলোই এখানে তুলে ধরছি।
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে প্রথমেই বলতে হবে পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। তাদের কথা আলোচনার আগে টানছি কেননা বর্তমান সমাজে তথাকথিত হর্তাকর্তা তাদেরকেই ধরা হয়। তাদের দিয়েই শুরু করা যাক।বর্তমান সমাজে নারী শিক্ষার হার বেশি বাড়লেও সমাজের উচ্চ পর্যায়ের কাজের জন্য নারীকে অযোগ্য বা কমযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় এই শতাব্দীতে এসেও। এই যে ৩৮ শতাংশ কর্মজীবী ধরা হচ্ছে, এই সংখ্যার একটা বড় অংশ যুক্ত রয়েছে কৃষিকাজে। কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ মোটামুটি চোখে পড়ার মত বলা চলে। আর বাকি অংশ যুক্ত পোশাক খাতে। কিন্তু যেমনটা বললাম, সমাজের উচ্চ পর্যায়ের কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ একেবারেই চোখে পড়ে না বললেই চলে। কেননা কর্মক্ষেত্রে নারীদের উচ্চ পর্যায়ের আসনকে পুরুষের অহংবোধ এ আঘাত বলে মনে করা হয়। সৃষ্টির শুরু থেকে পুরুষের আধিপত্যশীলতার ঐতিহ্য কর্মক্ষেত্রে খুব সুন্দরভাবে পালিত হচ্ছে বলেই আজকের এই লেখার পট রচনা করা গেল।
Advertisement
বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম এক গবেষণায় জানায়, বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রায় ২৮ শতাংশ। এছাড়া অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য এখনো ৫৬ শতাংশ। একই সঙ্গে, বিশ্বে লিঙ্গবৈষম্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯ তম।
এখন এই বৈষম্যের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে প্রথম কারণের পরেই যেই কারণকে লিপিবদ্ধ করতে হয়, সেটা হল- সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীদের দাসত্ববাদী মনোভাব বা পুরুষের আধিপত্যশীলতা মেনে নেওয়ার প্রবণতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জন্মের পর থেকেই পুত্র এবং কন্যা সন্তানকে আলাদা করে দেখার একটা মনোভাব আছে। কেননা ধরেই নেওয়া হয়, পুত্র সন্তান বংশের আলো, পিতামাতার বয়সকালের হাতের লাঠি কিংবা অন্ধের ষষ্ঠী। আর মেয়েদের কে মনে করা হয় সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রদত্ত এক দায়িত্ব। পিতামাতার দায়িত্বের এই বোঝা বেড়ানো চলে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত। এজন্য খাবার পাতে ছেলেকে মাছ মাংসের বড় টুকরা তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে জীবনের প্রত্যেক পর্বের যে বৈষম্য, সেটা দেখেই কন্যা সন্তান বড় হয় এবং নিজেকে অধস্তন ভাবার মনোভাব তখন থেকেই তাদের মধ্যে তৈরী হতে শুরু করে। যেটা বেশিরভাগ নারীর মধ্যে আজীবন স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তবে নারীর এই অধস্তন মনোভাব কেবলমাত্র এক প্রজন্মের নয় বরং এটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের। ফলে পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, সবখানে পুরুষের আদিপত্য তারা সহজভাবে এবং সহজাতভাবেই নিয়মমাফিক মেনে নেয়। অনেকটা ভাতের সাথে ডাল খাওয়ার মত করেই।
এই আধিপত্য মেনে নেওয়ার মনোভাব নারীদের ওপর এমনভাবে জেঁকে বসে যে সে তার জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত নিতেও পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয় এবং এই নির্ভরশীলতা কোন পুরুষ বিশেষের উপর নয় বরং পুরুষ সাধারণের উপরেই। এই নির্ভরশীলতার একটা সুন্দর উদাহরণ খুব সহজ একটা কথা দিয়েই বোঝা যায়।
কোনো মেয়েকে কখনই বলতে শোনা যায় না যে “ আমি বিয়ে করেছি বা করব”, সে সব সময় বলে-”আমার বিয়ে হয়ে গেছে বা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে”, কিন্তু একটা পুরুষ কখনোই বলবে না- "আমার বিয়ে হয়ে গেছে বা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে"। বলবে-”আমি বিয়ে করে ফেলেছি” অর্থাৎ একটা মেয়ে কখনোই মনে করে না যে সে নিজে নিজে বিয়ে করতে পারে। সে মনে করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর আবার অনেক নারীকে তো স্বামীর উদ্দেশ্যে এমনও কথা বলতে শুনেছি যে, "সংসার করতে হলে স্বামীর হাতে একটু আধটু মার খেতেই হয়। ও এমন কিছু না"। কত সরল স্বীকারোক্তি! পুরুষের আধিপত্য মেনে নেওয়ার মাঝেই যেনো এরা এক সুখানুভূতি খুঁজে পায়। আধিপত্য বরণ করে নেওয়ার এর থেকে সুন্দর উদাহরণ আর দেওয়া সম্ভব বলে আপাতত মনে করছি না।
৩য় কারণ হিসেবে বলবো সংসার আর নারী এই দুটি শব্দকে ওতপ্রোত মনে করা। যেন সংসার তৈরিই হয় মেয়েদের জন্য। মেয়েরা দেখেশুনে লালনে পালনে এটাকে বাড়াবে বলে।
বিয়ের আগে তার শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, হয় ভালো ছেলে পাওয়ার জন্য নয়তো তার সন্তানদেরকে যাতে ঠিকমত শিক্ষা দিতে পারে সেটা ভেবে। তাই বিয়ের পর একটা নারীর জীবন যে পুরুষের মত স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে, সেটা মনে করা হয় না। সংসারে আয়ের দায়িত্ব যেহেতু চিরাচরিতভাবেই পুরুষদের ওপর থাকে, বিশেষ করে এই ভারতীয় উপমহাদেশে। তাই আয় ব্যতীত সকল দায়িত্বের ছক কষে দেওয়া হয় নারীর ওপর। ফলে কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয়তাটাকেও বেশিরভাগ সময় পরিবারের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয়তার নাম দেওয়া হয় কিংবা উপেক্ষা করা হয়। আর নারীরাও স্বভাববশত স্বামী সংসার বাচ্চাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের পরিচয়টাকে হয় বিসর্জন দেয় আর নয়তো গড়েই উঠতে দেয় না। তারা নিজের অর্জিত শিক্ষা, তাদের বাবা মায়ের পরিশ্রমকে নিজের সন্তানের পেছনে ব্যয় করাকেই শ্রেয় মনে করে। সন্তানকেই সময় গুরুত্ব দিচ্ছে ভেবেই এক আত্মতুষ্ট থাকেন।
তারা যদি এই লেখাটি পড়ে থাকেন, তাদের কাছে একটা প্রশ্ন, ধরুন আপনার মেয়ে সন্তানকে আপনার সর্বস্ব ত্যাগ করে, নিজের শিক্ষা দিয়ে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে তাকে শিক্ষিত করে তুললেন, এরপর শিক্ষিত যোগ্য আপনার কন্যা সন্তান ও যদি আপনার মতই সিদ্ধান্ত নেয়? কি করবেন?
আর একশ্রেণির নারীসমাজ আছে, যারা নিজেরাই শিক্ষা অর্জনের পর নিজেদের কাজ ১৬ আনা শেষ বলে মনে করে। এবং বিয়েকেই তাদের পরবর্তী গন্তব্য বলে নিজেরাই ভেবে নেয়। যেহেতু তাদের ভরণপোষণের সকল দায়িত্ব সামাজিক কিংবা ধর্মকর্তৃক তাদের স্বামীর ওপরই বর্তায়, তাই তারা নিজস্ব পরিচিতি তৈরির দিকে কম মনোযোগী হন। ব্যক্তিগতভাবে আমার দুঃখ তাদের জন্য বেশি, যারা নিজের শিক্ষাটাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে আগ্রহী নন। যারা স্বামীর পরিচয়কেই নিজের পরিচয়ের আগে রাখেন।
এবারে সেই কারণটার উপর জোর দিতে হয়, যেই কারণের জন্য একসময়ের অনেক কর্মজীবী নারী আজ কর্মবিমুখ। বিবিএসের ২০১৮ সালের লেবার ফোরস সার্ভের মতে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৮ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করে। ধরে নিলাম তাদের মধ্যে ৪ লাখ নারী। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক নারী কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছে না, বা দিলেও টিকে থাকতে পারছেনা। যোগ না দেওয়ার কিছু কারন নিয়ে এতক্ষণ কথা বললাম। এবার আসি, কর্মস্থলে যোগ দিয়েও টিকে না থাকার কারণের মধ্যে কি কি আছে সেই ব্যাপারে।
তার মধ্যে একনম্বরেই আসবে কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টা। এই নিরাপত্তা মানসিক হতে পারে, এই নিরাপত্তা শারীরিক হতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীদের মতে, বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে এই দুইয়েরই অভাব আছে। মানসিক নিরাপত্তার অভাব বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নানান রকম মানসিকপীড়ন এর বিষয়টা, যা নারীসমাজ হরহামেশাই ভোগ করে থাকে। কারণে অকারণে কটু কথা, তাদের যোগ্যতাকে বাঁকা চোখে দেখা, তাদের এগিয়ে যাওয়াকে অনৈতিকতার আশ্রয়ের নাম দিয়ে মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া, আধিপত্য বিস্তার করে তাদেরকে দমিয়ে রাখা এসকল কিছু একজন নারীর কর্মক্ষেত্রে মানসিক নিরাপত্তার পরিপন্থী।
আর শারীরিক নিরাপত্তার বিষয়টা নতুন করে বলার মত কিছু না। কর্মজীবী নারী ও কেয়ার বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে আরেক তথ্য- বাংলাদেশের ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি।
২০২০সালে করোনা মহামারিকালীন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের সহায়তায় জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে প্রাথমিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৩৯০ জন নারীর একটি তালিকা তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে এই জরিপটিতে যৌন হয়রানি শিকার হয়েছেন এমন ১৩৫ জন কর্মজীবী নারী অংশগ্রহণ করেন। জানানো হয়, ১৩৫ জন নারীর শতভাগই নিজ কর্মস্থলে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান। তাদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ দুই-তিনবার, ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ নারী চার থেকে পাঁচবার এবং ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ নারী একবার করে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই জরিপ থেকে কর্মক্ষেত্র থেকে নারীর ছিটকে যাওয়ার বিষয়টা খুব স্পষ্ট।
এটা গেল কর্মক্ষেত্রে যোগদান করে নিরাপত্তাহীনতায় সরাসরি ভুক্তভোগী হয়ে ছিটকে যাওয়ার বিষয়টি। সমাজের যে অংশ ডিগ্রি অর্জন করার পরও এই আতঙ্কে কাজে যোগদানই করে না তাদের সংখ্যাও নেহায়তই কম নয়।এসকল অভিজ্ঞতার ভুক্তভোগী হয়ে, বা লোকমুখে এসব অভিজ্ঞতার কথা শুনে নারীরা একটা পর্যায় গিয়ে নিজেদেরকে কর্মক্ষেত্রে আবিষ্কারের কথা ভাবতেও ভয় পায়। মনোবল হারিয়ে ফেলে কিংবা নিজেদেরকে দুর্বল ভাবা শুরু করে। আর এই মনোবলের অভাব তারা আজীবন বহন করে চলে।
এই সকল কারণে কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা শিক্ষিত নারী সংখ্যা থেকে ৩০ শতাংশ পিছিয়ে। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিল- তাকে শিক্ষিত মা দিলে তিনি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবেন। কথা সত্য যে শিক্ষিত মা পারে তার সন্তান তথা জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে। কিন্তু সেটা যদি শুধুই শিক্ষার প্রসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কর্মমুখী না হয়ে তাহলে সেই শিক্ষা বা শিক্ষিত জাতি দেশ ও দুনিয়ার কতটুকু কাজে আসবে সেটা চিন্তার বিষয়।
আর নারী তথা সমাজের অর্ধাঙ্গিনীকে কর্মমুখী করে তুলতে উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের পথে না হাঁটলে কর্মবিমুখ শিক্ষিত ঐ ৩০ শতাংশ বেড়ে ৬০ শতাংশ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর জিডিপিতে নারীদের অবদানের সত্য তথ্য মিথ্যা হতেও সময় লাগবে না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/জিকেএস