বছরে আমদানি চার হাজার টনের মতো, অথচ দিনে ট্রেডিং হয় হাজার টনের! কাগজের স্লিপ হাতবদলে বাড়ানো হয় দাম, জড়িত প্রভাবশালী চক্র
Advertisement
আবুল হোসেন বাবুর্চি। চট্টগ্রামে নামকরা কয়েকজন বাবুর্চির মধ্যে তিনি প্রথম কাতারের। মেজবানসহ বড় বড় অনুষ্ঠানের রান্না হয় তার নেতৃত্বে। ৪০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ বাবুর্চির মতে, পাঁচ মণ গরু কিংবা মহিষের মাংস রান্নায় দুইশ গ্রাম এলাচের প্রয়োজন। আর কোরবানি কিংবা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজার সময়ও এলাচের ব্যবহার বাড়ে। এবার স্লিপ বেচাকেনাকারী অসাধু চক্রের হাতে পড়ে রোজার আগেই অস্থির এই এলাচের বাজার। ক্ষুব্ধ প্রকৃত আমদানিকারকরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতিজনের জন্য দিনপ্রতি ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে বছরে মাংসের চাহিদা ৭৬ লাখ ৮ হাজার টন। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি থেকে এসব মাংসের জোগান আসে। হিসাব অনুযায়ী পুরো বছরের চাহিদার সবগুলো মাংস রান্নায় এলাচ ব্যবহার করা হলে বছরে ৭ হাজার ৬শ টন এলাচের প্রয়োজন। তবে দেশে কমবেশি বছরে চার হাজার টন এলাচ আমদানি হয়।
অথচ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারেই প্রতিদিন হাজার টনের বেশি এলাচ ট্রেডিং হয়। খাতুনগঞ্জের মসলার পাইকারি ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, মধ্যস্বত্বভোগী কারবারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ তথ্য।
Advertisement
খাতুনগঞ্জে ডাল ও মসলার পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে এখন এলাচ নিয়ে যা হচ্ছে, তা ব্যবসা পর্যায়ে পড়ে না। এখানে এলাচের পরিবর্তে চোথা (স্লিপ) বেচাকেনা হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে অব্যবসায়ী মিলে এসব কাগজ বেচাকেনা করে এলাচের বাজার অস্থির করে রেখেছে। এসব স্লিপ বেচাকেনা করে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অনেকে উধাও হয়ে যেতে পারে। অতীতেও মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অনেকে খাতুনগঞ্জ থেকে পালিয়ে গেছে। এটা জুয়া খেলা। একজনের পকেটের টাকা অন্যজনের পকেটে চলে যাচ্ছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বড় বিক্রেতাদের সংযোগ তৈরি করার জন্য একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি রয়েছে। মসলা ব্যবসায়ও এ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন।
সম্প্রতি এলাচ ব্যবসায় খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক প্রভাবশালী একটি চক্রের যোগসাজশে আরেকটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা কখনো মসলা ব্যবসা করতেন না কিংবা এখনো সরাসরি মসলা ব্যবসায় যুক্ত নন। মূলত ‘ডিও’ নামে এক ধরনের স্লিপ হাতবদলের মাধ্যমে এলাচের বাজার অস্থির করে তোলেন তারা। সময়-সুযোগে কয়েক হাত বদল হয়ে দাম বাড়িয়ে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয় প্রভাবশালী চক্রটি।
আরও পড়ুন
Advertisement
চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন-কারখানার তালিকা নেই কারও কাছে কম দামে বেচা তেল বেশি দামে কিনলো বিপিসি, গচ্চা ১২৫ কোটি এখনো ঊর্ধ্বমুখী চিনি-খেজুরের দাম, কমেছে শুধু তেলের
গরম মসলার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এলাচ। বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরি ও মানের এলাচ আমদানি হয় দেশে। বাংলাদেশে আমদানি হওয়া সিংহভাগ এলাচ আসে গুয়াতেমালা থেকে। ‘আরএস-জাম্বো’, ‘জেবিসি’, ‘এলএমজি’, ‘এসএমজি’ ও ‘এসবি’ নামের এলাচ রয়েছে। ‘আরএস-জাম্বো’ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বড় ও উৎকৃষ্ট মানের (গ্রেড-১) এলাচ, ‘জেবিসি’, ‘এলএমজি’ হলো মধ্যমানের (গ্রেড-২), ‘এলএমজি ওল্ড’ এবং ‘ওয়াইএম-২’ নিম্নমধ্য মানের (গ্রেড-৩) এবং ‘এসএমজি’ ও ‘এসবি’ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের (গ্রেড-৪) এলাচ। ২০১৭ সালেও এসব এলাচের কেজি এক হাজার থেকে ১৫শ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে গুয়াতেমালায় এলাচ উৎপাদন কম হওয়ায় পণ্যটির দাম নিয়ে বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ওই বছরই কেজিপ্রতি পাঁচ হাজার টাকায়ও এলাচ বিক্রি হয়। পরের দুই বছর আমদানিকারকরা এলাচ আমদানি কমিয়ে দেন। অস্থিরতার সুযোগে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ২০২২, ২০২৩ সালের দিকে এলাচে বিনিয়োগ শুরু করেন। ফলে আমদানিও বাড়ে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৫০টি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ৬৭১ টন ২৫৬ কেজি এলাচ আমদানি করেন। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য ছিল ৮৫৪ টাকা ৪১ পয়সা। ২০২০ সালে ৬০টি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ১০১ টন ৬৮৩ কেজি এলাচ আমদানি করে। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য ছিল ৮৭৪ টাকা ৪৬ পয়সা। ২০২১ সালে ৭০টি প্রতিষ্ঠান চার হাজার ৩৯৫ টন ৮০ কেজি এলাচ আমদানি করে।
ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য ছিল ৯৫৯ টাকা ৫৫ পয়সা। ২০২২ সালে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান রেকর্ড ৬ হাজার ১ টন ২০৫ কেজি এলাচ আমদানি করে। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য ছিল এক হাজার ৪২ টাকা ৮৯ পয়সা। ২০২৩ সালে ৮৫টি প্রতিষ্ঠান চার হাজার ৬৭৭ টন ২৯০ কেজি এলাচ আমদানি করে। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য পড়ে এক হাজার ২৫৭ টাকা ১২ পয়সা এবং ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ১৩টি প্রতিষ্ঠান ২৩৭ টন ৮০ কেজি এলাচ আমদানি করে। ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য পড়েছে এক হাজার ২৬৭ টাকা ৩৭ পয়সা। জাহাজ ভাড়া, খালাস খরচ, পরিবহন ব্যয়, ব্যাংক সুদসহ এসব এলাচের দাম কেজিপ্রতি দেড় হাজার টাকা পড়ার কথা।
বেশ কয়েকজন মসলা ব্যবসায়ীর ভাষ্যমতে, শুল্ক ফাঁকি কিংবা কম শুল্ক দেওয়ার জন্য কম ঘোষণা (আন্ডার ভ্যালুয়েশন) দিয়ে এলাচ আমদানি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মসলা ব্যবসায়ী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন এলাচের গড় ক্রয়মূল্য ১৪ হাজার ডলার। কিন্তু এসব এলাচ টনপ্রতি সাড়ে ৭ হাজার ডলারে এলসি হচ্ছে। তা না হলে বর্তমানের চেয়ে প্রতি কেজি এলাচের আমদানিমূল্য ৫শ টাকা বেশি হতো।
মসলা ব্যবসায়ী মো. বাদশাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে এলাচের বাজার অস্থির। ২০২০ থেকে ২২ সাল পর্যন্ত এলাচে বড় অংকের লোকসান গুনেছেন আমদানিকারকরা। ওই সময়ে কেজিতে এক হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান দিতে হয়।’
খাতুনগঞ্জের মেসার্স আবু মোহাম্মদ অ্যান্ড কোম্পানি, মেসার্স গুলিস্তান ট্রেডিং এবং মেসার্স এ বি দাশ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি এলাচের শীর্ষ আমদানিকারক। তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান তিনটি ২০১৯ সালে ১ হাজার ৫৯ টন, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪৬ টন, ২০২১ সালে ১ হাজার ১১০ টন, ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৪৯ টন, ২০২৩ সালে ১ হাজার ১৯২ টন এবং ২০২৪ সালের দুই মাসে ৫০ টন এলাচ আমদানি করে।
এলাচের মূল আমদানিকারক কিংবা পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা এ ধরনের স্লিপ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। মূল ব্যবসায়ীরা এটাকে জুয়া হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। দেশের শীর্ষ এলাচ আমদানিকারক মেসার্স আবু মোহাম্মদ অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী আবু মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। অফিসে যাওয়া হয় না। আমরা এলাচ আমদানি করে বিক্রি করি। কারও কাছে স্লিপ বিক্রি করি না। মূলত সোনা মিয়া মার্কেটের একটি চক্র স্লিপ বিক্রি করে এলাচের বাজার অস্থির করছে। চাইলেও তারা মূল মসলা ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের ডিও বিক্রি করে না। কারণ তাদের কাছে এলাচ নেই। এটি ব্যবসা নয়। তারা মূলত কাগজ দিয়ে জুয়া খেলছে। কেউ জিতছে, কেউ হারছে।’
আরেক আমদানিকারক মেসার্স এ বি দাশ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির স্বত্বাধিকারী অমর কান্তি দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের মূল মসলা ব্যবসায়ীদের কেউ ডিও বিক্রির সঙ্গে জড়িত নয়। যারা এলাচের ডিও বিক্রি করছে, তাদের কেউ আগে মসলা ব্যবসা করেনি। এখনো করছে না। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে। মূল আমদানিকারক কিংবা ব্যবসায়ীদের যাতে হয়রানি করা না হয়।’
খাতুনগঞ্জের ইলিয়াছ মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স ফেয়ার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা নগদ টাকা দিয়ে এলাচ বেচাকেনা করি। ডিও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এখানকার মসলা ব্যবসায়ীদের সংযোগ নেই।’
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে খুচরা বাজারে ছোট এলাচের মূল্য প্রতি কেজি ২৫শ থেকে ৩৫শ। একবছর আগে ছিল ১৬শ থেকে ২৬শ টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে এসব এলাচের দাম ছিল ১৯৫০ থেকে তিন হাজার টাকা। ২০২১ সালে একই এলাচের দাম ছিল ২৪শ থেকে ৩৫শ টাকা। ২০২০ সালে ছিল ৩৫শ থেকে ৪৪শ টাকা।
পাশাপাশি বর্তমানে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে বড় সাইজের ‘আর এস জাম্বো’ প্রতি কেজি ২৯শ টাকা, মধ্যমানের ‘জেবিসি’, ‘এলএমজি’ এলাচ প্রতি কেজি ২৬শ টাকা, নিম্ন মধ্যমানের ‘এলএমজি ওল্ড’ ও ‘ওয়াইএম-২’ এলাচ প্রতি কেজি ২২৫০ টাকা এবং ছোট ‘এসএমজি’ এলাচ বিক্রি হচ্ছে ২১৫০ টাকা কেজিতে। এর মধ্যে শুধু ‘জেবিসি’ এলাচই স্লিপ কেনাবেচার নামে ট্রেডিং হয়। প্রতিটি ডিও এক টন আকারে কেনাবেচা করেন ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা।
জাগো নিউজের অনুসন্ধান বলছে, খাতুনগঞ্জে সোনা মিয়া মার্কেটকেন্দ্রিক হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী এলাচ ট্রেডিংয়ের সঙ্গে জড়িত। মূলত তারা ভোজ্যতেল এবং চিনির ব্যবসা করেন। ভোজ্যতেল এবং চিনির ডিও ব্যবসায় মন্দা চলার কারণে তারা এলাচকে ডিও ব্যবসার ঢাল বানিয়েছে বলে দাবি প্রকৃত মসলা ব্যবসায়ীদের।
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস