ফিচার

গ্রামীণ জনপদে পহেলা বৈশাখ

‘মুছে যাক গ্লানি/ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’- স্লোগানকে উপজীব্য করেই আসে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। চারিদিকে নতুনের আবাহন। গাছে গাছে নতুন পাতা। বাতাসে দোলে পাকা ধানের শীষ। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃক্ষরাজি, শ্যামল ফসলের মাঠ। বাঙালির মনে জেগে ওঠে অন্য এক আবেগ। ক্রমান্বয়ে তা রূপ নেয় উৎসবে। বর্তমানে গ্রাামীণ জনপদেও আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। আর একদিন পরই পালিত হবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তর তর হে’। পহেলা বৈশাখে সারাদেশেই নামবে আনন্দের ঢল। দিকে দিকে ধ্বনিত হবে- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ গানটি।ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালের ১০ কিংবা ১১ মার্চ ফসলি সন হিসেবে বৈশাখ মাসকে বাংলাবর্ষের প্রথম ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। তবে বর্ষপঞ্জিটি কার্যকর হয় তার সিংহাসনে বসার সময় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালের হিসাব ধরে। তখন থেকেই বাংলা নববর্ষ আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো।১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহাযুদ্ধ চলার সময়ও বাংলায় বৈশাখী মেলা আয়োজনের তথ্য পাওয়া যায়। তখন ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ সালেও এ ধরনের পূজার তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৬৭ সালের আগে বিপুল আয়োজনে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন জনপ্রিয় হয়নি। নববর্ষ উদযাপনের রীতি যত জনপ্রিয় হয়েছে মেলার সংখ্যাও বেড়েছে। ’৭০ থেকে ৯০’র দশক পর্যন্ত মেলায় গ্রামীণ আবহ ছিল পুরোদমে। নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা।পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আচার অনুযায়ী এদিন করলা, পাটশাক, শুঁটকি ইত্যাদিসহ বিভিন্ন শাক-সব্জি দিয়ে বিশেষ ধরনের রান্না করে খাওয়া হয়। পহেলা বৈশাখ সকালে শিশুরা সেজেগুজে বের হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। পান্তা-ইলিশের আয়োজনও থাকে এতে। ছোটদের সাথে তাল মিলিয়ে বড়রাও যথাসাধ্য নতুন পোশাক পরার চেষ্টা করে। ঘরে ঘরে নতুনকে বরণ করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বাড়িতে অতিথির আগমন ঘটে। জামাই-মেয়ে বেড়াতে আসে বাপের বাড়ি। চারিদিকে একটা উৎসবের আমেজ ফুটে ওঠে।গ্রামে এই সময়টাতে ঘরে ঘরে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। প্রতি বছর নিজেদের ক্ষেতের ফসল থেকে কিছুটা ধান গ্রামের কৃষকরা সবসময়ই আলাদা করে রাখে। বৈশাখের প্রথম দিনেই কৃষক তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে যায় ধানক্ষেতে। বোনে ধানের প্রথম বীজ। কৃষক বউ জমানো বীজধানের কিছুটা দিয়ে রান্না করে আমক্ষীর। পায়েস বা ক্ষীরের সঙ্গে গাছের কাঁচা আম মিলিয়ে বানানো এই উপাধেয় খাবার বানাতে তাকে সাহায্য করে ঘরের ছোট্ট মেয়েটি।এদিন বৈশাখী মেলা বসে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাট এলাকা, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছী, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি-বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কালকিনি ও টুঙ্গিপাড়ায়। এছাড়ার শুভাঢ্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর স্নানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকূল মেলা, কুকটিয়া মেলা, রাজনগর মেলা, দিনাজপুরের ফুলতলী, ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলীর বৈশাখী মেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে।বর্তমানে দেশের অধিকাংশ গ্রাম ও মফস্বল শহরে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলা একাকার হয়ে গেছে। মূলত চৈত্রসংক্রান্তির মেলাগুলো দুই থেকে সাত দিন ধরে আয়োজনের ফলে এমনটা হয়েছে। তবে অধিকাংশ মেলাই এখন পণ্যসমাহারের স্থানে পরিণত হয়েছে। কৃষিজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মিষ্টান্ন ও মাটির তৈরি নানা ধরনের পণ্যের বিপুল সমাহার ঘটে মেলার দোকানগুলোতে। বাজারের খোলা জায়গায়, কয়েকটি গ্রামের মিলনস্থল বড় ময়দান কিংবা বিদ্যায়তনের মাঠে এ মেলা বসে। দোকানগুলোতে কৃষকদের নিত্যব্যবহার্য লাঙল ও জোয়ালের দেখা মিলত দুই দশক আগেও। এখন গ্রামীণ এ মেলাগুলোতে দা, বটি, কোদাল, হাতুড়ি, কাঁচি, ছুরি, পিতল-কাঁসা, বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্রের দেখা মেলে। মেলায় শুধু কেনাকাটা নয় বিনোদনও মেলে। সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচের দল, ম্যাজিক শো মেলাকে করে তোলে আরো বর্ণিল ও আনন্দময়।এসইউ/পিআর

Advertisement