মতামত

আমার স্মৃতিতে একাত্তরের উত্তাল মার্চ

১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। ভয়ংকর হয়ে উঠলো পরিস্থিতি। ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও ৩৫ জন পরিষদ সদস্য ১ মার্চের আগেই ঢাকা এসে গিয়েছিলেন, আরো অনেকে ঢাকার পথে ছিলেন। ন্যাপ সভাপতি ওয়ালী খান বললেন, ‘আমি ঢাকা যাচ্ছি। ভুট্টোর সাধ্য থাকলে আমাকে ঠেকাক দেখি।’ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ন্যাপ নেতারা ঢাকায় এসে সাধারণত সংবাদ সম্পাদক আহমদুল কবিরের বাসায় উঠতেন। বেশি সংখ্যায় আসলে হোটেল শাহবাগে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)।

Advertisement

পহেলা মার্চ বিকেলে হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা চলছিল। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘আমরা এই অবিচারের উপযুক্ত জবাব দেবো।’ সংবাদ সম্মেলনে আরো বললেন, তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান ও নূরুল আমিনের সঙ্গে আলাপ করবেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘২ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে হরতাল পালিত হবে। এর মধ্যে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ না নিলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি চূড়ান্ত কর্মপন্থা ঘোষণা করবো।’

ঢাকা শহর তখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে মানুষ। ঢাকা স্টেডিয়ামে ১৯৭০-এর নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকার মানুষকে সাহায্য করার জন্যে কমনওয়েলথ বনাম পাকিস্তান একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। বেলা একটা ৫ মিনিটে রেডিওতে ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা শুনে স্টেডিয়াম থেকে হাজার হাজার দর্শক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্লাস থেকে, হল থেকে বেরিয়ে বটতলায় জড়ো হয়। সেখানে জিন্নার ছবি আর পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হলো। তারপর তারা মিছিল করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে পল্টনে আসে।

ডাকসু আর ছাত্রলীগ সভা শুরু করে পল্টন ময়দানে। ছাত্র ইউনিয়ন আর ন্যাপ বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে পড়ে। ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে আসে। হোটেল পূর্বাণীর কাছে এসে দেখি হাজার হাজার লোক বাঁশের লাঠি, লোহার রড ইত্যাদি উচিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছে ‘জয় স্বাধীন বাংলা।’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। ‘স্বাধীন জাতি, জাতির পিতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই। গর্জে উঠেছে লাখো জনতা। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। ‘দরবারে জহুর’ খ্যাত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী তাঁর স্ত্রীকে আনতে যান কামরুন্নেসা স্কুল থেকে। বাসা থেকে ১৫ মিনিটের পথ। কিন্তু মানুষের অরণ্যে গাড়ি চলছিল প্রায় নিশ্চলভাবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমার গাড়িটা যেন পিঁপড়ার মতো চলছিল। ১৫ মিনিটের পথ পার হলাম কয়েক ঘণ্টায়।’

Advertisement

পহেলা মার্চ, ১৯৭১ বিকালে হোটেল পূর্বাণী থেকে শাহবাগ হোটেলে যাই। এখানে পাকিস্তান ন্যাপের নেতৃবৃন্দ এসে উঠেছেন। অবশ্য ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান উঠেছেন ইন্দিরা রোডে আহমদুল কবিরের বাসায়। বেলা একটা পাঁচ মিনিটে রেডিওতে সামরিক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি প্রচারিত হয়। ইয়াহিয়া আসন্ন ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রাদেশিক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও আমি ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত ন্যাপ অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এমন সময় নটরডেম কলেজের তরুণ-অধ্যাপক গৌরাঙ্গপ্রসাদ মিত্র এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। এখানে তরুণ অধ্যাপক গৌরাঙ্গপ্রসাদ মিত্র এবং তার মোটর-সাইকেল সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলতে হয়। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তার ছিল একটি ৫০ সিসি ইয়ামাহা মোটর-সাইকেল। ন্যাপের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আমার দ্রুত যোগাযোগের জন্য তার এই বাহনটির প্রতি ছিল আকর্ষণ। আমি তাকে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক গাউস বক্স বেজেঞ্জোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আলাপরত অবস্থায় বেজেঞ্জোকে বললাম, ‘আমরা তো স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। আপনারা কী করবেন?’

গাউস বক্স বেজেঞ্জো তখন বলেন, ‘আপনারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন!’ একটু বিরতি নিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনাদের তো লোকজন অনেক আছে। শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালাতে পারবেন। আমাদের তো লোকজন অনেক কম। ইউ সি, আমরা বাঙালিদের দিকে চেয়ে আছি। আপনারা ক্ষমতায় গেলে আমরা বালুচ-পাঠানরা পাঞ্জাবিদের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাবো। আর আপনারা স্বাধীন হলে পাঞ্জাবিরা আমাদের আখের মতো চিবিয়ে ফেলে দেবে।’

ইয়াহিয়ার রেডিও-ঘোষণার পর ন্যাপ ওয়ার্কিং কমিটির সভা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টায় পিছিয়ে দেয়া হয়। খবরটি ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খানকে দেয়ার জন্য আমি গৌরাঙ্গর ইয়ামাহা মোটর সাইকেলে চড়ে আহমদুল কবিরের বাসায় গেলাম। সেখানে খবর দিয়ে আমরা এলাম ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে ন্যাপ অফিসে। এদিকে ইয়াহিয়ার ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে ঢাকায় ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে পড়ে। নেতা-কর্মীরা আমাদের ন্যাপ অফিসে চলে আসেন। তাদের নিয়েই মিছিল করে রাস্তায় নামলাম। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভরত। তাদের হাতে বাঁশের লাঠি, লোহার রড। কণ্ঠে গগণবিদারী স্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘স্বাধীন জাতির পিতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।

বাঙালির এমন বিদ্রোহী রূপ জীবনে এর আগে দেখিনি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও রাস্তায় বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে ছিলাম। কিন্তু একাত্তরের জনতার মেজাজ ভিন্ন। এ জনতা কোনো বাধা মানতে রাজি নয়। হাতে লাঠি নিয়েই তারা দেশ স্বাধীন করার মরণপণ সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে কে একজন একটি কাঠের টুল এনে রাখলো, এর ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়ার জন্য। আমি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলাম, ‘এখন বক্তৃতা করবেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি... শেষ করতে পারলাম না। দলের কয়েকজন আমার সার্ট ধরে টানাটানি শুরু করলেন। তারা আমাকে বললেন, ‘বাংলাদেশ ন্যাপ বলছো কেনো?’

Advertisement

আমি তাদের কথায় ভ্রƒক্ষেপ না করে আবার ঘোষণা করি, ‘এখন বক্তৃতা করবেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।’সভার শুরুতেই গৌরাঙ্গপ্রসাদ মিত্র কাছে এসে আমার কানে কানে বললেন যে তাকে কিছু লোক সন্দেহের চোখে দেখছে। আসলে সুদর্শন গৌরাঙ্গর চেহারা অনেকটা অবাঙালির মতো দেখতে। কেউ কেউ ভুল করে তাকে ইউরোপিয়ান বলেও মনে করে, কারণ তিনি নটরডেম কলেজের শিক্ষক।

অবস্থা বুঝতে পেরে আমি আবার টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বললাম, ‘প্রথমে আপনাদের সামনে বক্তৃতা করবেনÑ নটরডেম কলেজের অধ্যাপক গৌরাঙ্গপ্রসাদ মিত্র।’ সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতার হাততালি। গৌরাঙ্গ রক্ষা পেলেন। তিনি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতার পরিবর্তে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিতে থাকলেন, ‘জয় বাংলা...’ জনতাও তার সাথে সাথে সমবেত কণ্ঠে স্লোগান দেয়। এরপর গৌরাঙ্গ যেই স্লোগান দিলেন, ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি জিন্দাবাদ’- দলের দুই-তিনজন কর্মী ব্যতীত কেউ তাতে সাড়া দিলো না। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই এক লোক লোহার রড হাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘জিন্দাবাদ বলবেন না, বলবেন জয়’। গৌরাঙ্গ নিজেকে সংশোধন করে স্লোগান দেন, ‘জয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি।‘ জনতা তার স্লোগান গ্রহণ করলো।

 

গুলিস্তান থেকে শান্তিনগর আসার পথে দূরে গুলির শব্দ শুনতে পাই। ৩ মার্চ, সংবাদপত্রগুলোর জন্য একটি সামরিক আদেশ জারি হয়, ‘যদি কোনো সংবাদপত্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত অথবা ছবি প্রকাশ করে তবে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।’ বাংলাদেশে তখন কোনো সংবাদপত্র সে আদেশ মানেনি। গোটা জাতি পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

 

পরদিন ২ মার্চ, ১৯৭১। আওয়ামী লীগসহ সমস্ত রাজনৈতিক, ছাত্র ও শ্রমিক ছাত্র ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও কৃষক সমিতি সম্মিলিতভাবে বিকালে সভা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ছাত্রলীগ ও ডাকসু যৌথভাবে বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েলয় কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণে ও বিকাল ৪টায় পল্টন ময়দানে সভা আহ্বান করে। আতাউর রহমান খানের দল ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সভা হয়।

শহীদ মিনারে সভাশেষে আমরা মিছিল করে গুলিস্তান হয়ে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে আসি। ১৯৭১-এর ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চ দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল থাকায় এ সময় সভাগুলো হতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এবং বিকালে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ ও পল্টন ময়দানে। সন্ধ্যায় বের হতো বড় বড় মশাল মিছিল।

ছাত্র-শ্রমিক-জনতার মিছিল-জনসভার রূপ ছিল জঙ্গি। এক দফা-স্বাধীনতার পক্ষে ব্যতীত অন্য কোনো বক্তব্য তারা শুনতেই চাইতো না। জনতার হাতে থাকতো হয় লাঠি না হয় লোহার রড। ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও কৃষক সমিতির সম্মিলিত মশাল মিছিল শেষে আমরা ন্যাপ অফিসে এলাম। অফিসে বসে আলাপ করছি এমন সময় অধ্যাপক গৌরাঙ্গ আসেন। তাকে দেখেই বললাম, ‘কোথাও যাবেন না, একটা কাজ আছে।’

কিছুক্ষণ বাদে দলের একগোছা সংবাদ-বিজ্ঞপ্তি নিয়ে তা সংবাদপত্র অফিসসমূহে পৌঁছে দিতে বের হলাম। গৌরাঙ্গ মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন, আমি তার পেছনে বসে। মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান, পাকিস্তান অবজারভার, ইত্তেফাক হয়ে আমরা ২৬৩ নম্বর বংশাল রোডে সংবাদ অফিসে যাই। তখন সংবাদ অফিস বংশাল রোডে ছিল। ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার দিয়ে সংবাদ অফিস ধ্বংস করে দেয়। এই হামলাকালে অফিসের ভেতরে সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদ সাবের আগুনে পুড়ে শহীদ হন।

যাই হোক, ২ মার্চ রাতে রাস্তায় কোথাও পুলিশ নেই। মাঝে মাঝে ইপিআর গাড়ি নিয়ে টহল দিচ্ছে। রাস্তায় লোকজনও খুব কম। গুলিস্তান এলাকায় ‘এনা’ সংবাদ-সংস্থার অফিসে সংবাদ-বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে দিয়ে আবার আমরা মোটর সাইকেলে চড়ি।

এমন সময় মাইকে শুনতে পেলাম পুলিশ কারফিউ জারির ঘোষণা দিচ্ছে। রেডিও পাকিস্তানে আগেই কারফিউর সংবাদ প্রচার হয়। কিন্তু তখন অধিকাংশ শ্রোতা রেডিও পাকিস্তান শুনতো না। আমরাও তাই কারফিউ জারির খবর আগে জানতে পারিনি। গৌরাঙ্গ দ্রুত মোটর সাইকেল চালিয়ে আমাকে শান্তিনগর মোড়ে নামিয়ে দিয়ে কলাবাগান চলে যান।

গুলিস্তান থেকে শান্তিনগর আসার পথে দূরে গুলির শব্দ শুনতে পাই। ৩ মার্চ, সংবাদপত্রগুলোর জন্য একটি সামরিক আদেশ জারি হয়, ‘যদি কোনো সংবাদপত্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত অথবা ছবি প্রকাশ করে তবে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।’ বাংলাদেশে তখন কোনো সংবাদপত্র সে আদেশ মানেনি। গোটা জাতি পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

৭ মার্চ, ১৯৭১ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। বিদ্রোহী বাঙালির দাবি স্বাধীনতা। সমস্ত বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ। ঢাকায় দুপুর থেকেই লাঠি এবং মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে লাখ লাখ মানুষের স্রোত রেসকোর্সমুখী। মুখে তাদের স্বাধীনতার স্লোগান।

এখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রসঙ্গে বলতেই হয়। ২ মার্চ ছাত্রনেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বিশাল ছাত্র-জনতার সমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়িয়ে দেন। পতাকার পরিকল্পনা ও অঙ্কন করেন শিবনারায়ণ দাস। কাপড় কেটে স্বাধীন বাংলার পতাকাটি প্রথম তৈরি করেন হাছিনা রহমান। তিনি ছিলেন সাবেক পাকিস্তানের প্রথম ব্যাচের সিএসপি ও ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত আহমদ ফজলুর রহমানের স্ত্রী। পতাকার জন্য স্বাধীন বাংলার মানচিত্র এঁকে দেয় তাদের মেঝ মেয়ে রিয়া, স্থপতি, আমেরিকায় বসবাস করতো, বর্তমানে মৃত।

এদিকে ন্যাপ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রেসকোর্সের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশের ঘোষণা দিলে সভাস্থলে পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট হামলা চালাবে। এ সম্পর্কে তদানীন্তন ন্যাপনেতা ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর রচিত ‘আমার জীবন আমার রাজনীতি’ বইয়ে উল্লেখও করেন, ‘ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা শেখ সাহেবের কাছে গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, নেতা যেন কোনো অবস্থাতেই যুব নেতা ও ছাত্রনেতাদের চাপে স্বাধীনতা ঘোষণা না করে বসেন। যদি শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন তাহলে তাকে জেনারেল খাদিমকে) সভাস্থলে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট নিয়ে হামলা চালাতে হবে। এমন কি সামরিক বিমান থেকে ট্র্যাকিং মানে গুলি ছোড়া হতে পারে? বিকালে সভাস্থলে আমরা বিমান উড়তে দেখি। বেলুচিস্তানের কসাই, কুখ্যাত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান নতুন প্রাদেশিক গবর্নরের দায়িত্ব পেয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। ফলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভাস্থল সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান ছিল।’

যাই হোক বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ উল্লেখ করে গেরিলা যুদ্ধের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেন। তিনি বাংলার ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোলার আহ্বান জানিয়ে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। আর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’ বলে ভাষণ শেষ করেন বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ বাঙালি জাতির আর বুঝতে বাকি থাকেনি কিছু। আমরাও পূর্বাভাস মতো গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা শুরু করি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমি ও স্থপতি মাযহারুল ইসলাম টেপ রেকর্ডে ধারণ করেছিলাম।পরবর্তী ঘটনাবলি এখন তো ইতিহাস, সবারই জানা।

০৪ মার্চ, ২০২৪লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস