জাতীয়

রাজউক কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ

***অনুমোদন ছাড়া রেস্টুরেন্ট আর দোকান ভাড়া দেয় স্বত্বাধিকারী***অবহেলা ও অসাবধানতায় মজুত থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড***মালিক ও ম্যানেজারদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাৎক্ষণিক সন্ধান করেও পাওয়া যায়নি***বেপরোয়া, অবহেলা আর অসাবধানতায় ৪৬ জনের নির্মম মৃত্যু

Advertisement

২৯ ফেব্রুয়ারির ক্ষতচিহ্ন বহন করা রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির নাম এখন সবার জানা। ভবনটিতে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যু ভয়াবহ বার্তা দিচ্ছে। এটি আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মিত হলেও পরবর্তী সময়ে অবৈধভাবে চলে ব্যবসা-বাণিজ্য।

গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপ। ভবনটির ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, ‘চুমুক’ ফাস্ট ফুডের মালিক আনোয়ারুল হক, ‘কাচ্চি ভাই’ নামের রেস্টুরেন্টের মালিক মো. সোহেল সিরাজসহ ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে অবস্থিত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাণিজ্যিক সনদ সংগ্রহ করেন। ভবনটির সব রেস্টুরেন্টের মালিকরা রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বা চুলা ব্যবহারে ফায়ার সার্ভিস থেকে কোনো অনুমতিপত্র গ্রহণ করেননি।

এজাহারে উল্লিখিত আসামি ও অন্যান্য রেস্টুরেন্টের মালিক ও ম্যানেজাররা যথাযথ নিয়ম ব্যতিরেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দোকান পরিদর্শক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করেন। গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করে দেদারসে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন তারা।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের এই ভবনটিতে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণ গেছে। শ্বাসনালী পুড়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও অনেকে।

এ ঘটনায় শুক্রবার (১ মার্চ) রমনা থানায় এসআই মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও অনেককে। মামলার এজাহারে এসব কথা উল্লেখ করেন মামলার বাদী। মামলায় দণ্ডবিধি ৩০৪ (এ),৩০৭,৩৩৮, ৪৩৬, ৪২৭, ১০৯ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই মামলার আসামিরা হলেন গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপ, ভবনটির ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, ‘চুমুক’ ফাস্ট ফুডের মালিক আনোয়ারুল হক, ‘কাচ্চি ভাই’ নামের রেস্টুরেন্টের মালিক মো. সোহেল সিরাজ।

আটকের পর শনিবার (২ মার্চ) কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজার জিসান, চা চুমুকের মালিক আনোয়ারুল হক ও শাকিল আহমেদ রিমন এবং গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ম্যানেজার হামিমুল হক বিপুলকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনছার মিলটন তাদের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নুরুল হুদা চৌধুরি প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

Advertisement

আরও পড়ুন

আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ ও ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চেয়ে রিট

কেন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেন না, প্রশ্ন দোকান মালিক সমিতির সভাপতির

নিমতলী-চুড়িহাট্টা-বনানীর ঘটনায় কিছু হয়েছে?

অনুমোদন ছাড়া বেশকিছু রেস্টুরেন্ট এবং দোকান ভাড়া দেয় স্বত্বাধিকারী

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, প্রাথমিকভাবে জানা যায় যে, ভবনটির স্বত্বাধিকারী ও ম্যানেজার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া বেশকিছু রেস্টুরেন্ট এবং দোকান ভাড়া দেয়। রেস্টুরেন্টগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যতিরেকে রান্নার কাজে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং চুলা ব্যবহার করে থাকে। রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য এজাহারনামীয় আসামিসহ ভবনের স্বত্বাধিকারী এবং ম্যানেজারের যোগসাজসে ‘চুমুক’ ফাস্ট ফুড, ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্ট, মেজবানী রেস্টুরেন্ট, খানাস ফ্লাগশিপ, স্ট্রিট ওভেন, জেষ্টি, হাক্কা ঢাক্কা, শেখ হলি, ফয়সাল জুসবার (বার্গার), ওয়াফেলবে, তাওয়াজ, পিজ্জাইন, ফোকো, এস্ত্রোশিয়া নামীয় রেস্টুরেন্ট মালিকরা ভবনটির নিচতলায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করেন। জননিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ এবং বিপজ্জনকভাবে এই গ্যাস সিলিন্ডার এবং গ্যাসের চুলা ব্যবহার করে আসছিল।

অবহেলা ও অসাবধানতাভাবে মজুত থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটে

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ভবনটির নিচতলায় থাকা রেস্টুরেন্টের রান্নার কাজে অবহেলা ও অসাবধানতামূলকভাবে মজুত করে রাখা এই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং এই আগুনের তাপ ও প্রচণ্ড ধোঁয়া পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে বিভিন্ন ফ্লোরে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ও দোকানে অবস্থানকারী লোকজন আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়া শ্বাসনালীতে ঢুকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান এবং গুরুতর আহত হয় বলে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়।

মালিক ও ম্যানেজারদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সন্ধান করেও পাওয়া যায়নি

মামলার এজাহারে বাদী আরও উল্লেখ করেন, স্থানীয়ভাবে জানা যায় যে, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপ এবং ভবনটির ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল (৪৫)। ‘চুমুক’ ফাস্ট ফুডের মালিক আনোয়ারুল হক (২৯), ‘কাচ্চি ভাই’ নামের রেস্টুরেন্টের মালিক মো. সোহেল সিরাজ (৩৪)। উল্লিখিত মালিক ও ম্যানেজারদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সন্ধান করেও পাওয়া যায়নি। অন্যান্য রেস্টুরেন্ট এবং দোকান মালিকদের নাম ঠিকানা তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি।

অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়ার জন্য ৪৬ জন মানুষের নির্মম মৃত্যু

মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, গ্রিন কোজি কটেজের স্বত্বাধিকারী ও ম্যানেজার, রেস্টুরেন্টগুলোর মালিক ও ম্যানেজাররা ভবন ব্যবহারের যথাযথ নিয়ম অমান্য করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর জন্য ভাড়া দিয়েছে। এজাহারে উল্লিখিত আসামিরা ও অন্যান্য রেস্টুরেন্টের মালিক ও ম্যানেজাররা যথাযথ নিয়ম ব্যতিরেকে রাজউকের দোকান পরিদর্শক অফিসারদেরকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করে, গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যাবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। আসামিসহ ভবন স্বত্বাধিকারীর এ অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজের জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে লাগা আগুনে দগ্ধ হয়ে ও শ্বাসনালীতে ধোঁয়া প্রবেশ করে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ৪৬ জন মানুষের নির্মম মৃত্যু ঘটেছে। আরও বহু সংখ্যক মানুষ আগুনে পুড়ে গিয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

জেএ/এসএনআর/এএসএম