অর্থনীতি

বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান নৌ-বাণিজ্য হাব হবে চিলমারী নদীবন্দর

ভারত-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে নৌপথে বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান, নেপালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ চিলমারী বন্দর। এ নদীবন্দরকে ঢেলে সাজাতে আরও শতকোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় চিলমারী বন্দরের পার্কিং ইয়ার্ড, যাত্রী ছাউনি, স্টোরেজ হাউজ ও সড়কসহ নানা অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।

Advertisement

বাংলাদেশ-ভারত নৌ-বাণিজ্য প্রটোকল রুটের আওতায় ভারতের আসাম, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনে অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে চিলমারী বন্দরকে ঢেলে সাজানো হবে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আরও শতকোটি টাকা ব্যয় করা হবে ‘চিলমারী এলাকায় (রমনা, দোড়গাছ, রাজিবপুর, রৌমারী, নয়ারহাট) নদীবন্দর নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায়। এ প্রকল্পের ব্যয়-মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় জানায়, ভূমি অধিগ্রহণ, রেট শিডিউল বৃদ্ধি ও নতুন কিছু আইটেম যুক্ত হওয়ার কারণে ১০০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেড়েছে চিলমারী নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে। মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এখন ১০০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। জুলাই ২০২১ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ডিসেম্বর ২০২৩ নাগাদ। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে ডিসেম্বর ২০২৫ নাগাদ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

‘নৌপথে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে বাণিজ্যিক হাব হবে চিলমারী বন্দর। এ প্রকল্পের আওতায় পার্কিং ইয়ার্ড, যাত্রী ছাউনি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান। ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট অনুযায়ী উভয় দেশে নৌপথে বাণিজ্য বাড়বে। পাথর-কয়লা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য নৌপথে পরিবহন করা হবে। পাশাপাশি যাত্রীবাহী সার্ভিসও চালু করা হবে’— বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম

Advertisement

বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নৌপথে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে বাণিজ্যিক হাব হবে চিলমারী বন্দর। ফলে প্রকল্পের আওতায় পার্কিং ইয়ার্ড, যাত্রী ছাউনি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হবে। বাণিজ্যিক হাব গড়ে তুলতে সবকিছুই হবে। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান। ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট অনুযায়ী উভয় দেশে নৌপথে বাণিজ্য বাড়বে। পাথর-কয়লা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য নৌপথে পরিবহন করা হবে। যাত্রীবাহী সার্ভিস চালু করা হবে।’

প্রকল্পের আওতায় রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার কতিপয় এলাকার নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে চিলমারী এলাকায় বন্দর অবকাঠামো সুবিধা নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমপরামর্শক সেবা, ১১ দশমিক ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ২ লাখ ৫১ হাজার ভূমি উন্নয়ন, ২ হাজার ৪৮০ বর্গমিটার ভূমি উন্নয়ন, ১০ হাজার বর্গমিটার আরসিসি পেভমেন্ট, ৭৮৫ মিটার তীর রক্ষার কাজ ও ৩৩ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ করা হবে।

আরও পড়ুন☞ বাংলাদেশের সমুদ্র ও স্থলবন্দর ব্যবহার করতে চায় নেপালবিদেশি পর্যটক নিয়ে চিলমারী বন্দরে প্রমোদতরী এমভি চরাডিওপায়রা বন্দর হবে দেশের দ্বিতীয় ইকোনমিক করিডোর: চেয়ারম্যান

Advertisement

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জানায়, চিলমারী বন্দর কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত, যা জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। এ বন্দরটি এক সময় কৃষিপণ্য বেচাকেনা এবং যাত্রী ও পণ্য পারাপারের অন্যতম প্রধান বন্দর-বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল। যমুনা নদীর ভাঙন দিন দিন এ বন্দরের গুরুত্ব কমিয়েছে। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে অসংখ্য যাত্রী এবং পণ্য রৌমারী, রাজীবপুর, কোদালকাটি, নয়ারহাট, অষ্টমিরচর এলাকা থেকে চিলমারী এলাকায় আনা-নেওয়া করা হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ যাত্রী এ এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে। শুধু রৌমারী ও চিলমারীর মধ্যেই প্রতিদিন বৃহদাকার ৮-৯টি জলযান আসা-যাওয়া করে। চিলমারী এবং রাজীবপুরের মধ্যেও একই সার্ভিস বিদ্যমান। ৬-৭টি বৃহদাকার ইঞ্জিনবোট বিভিন্ন স্থান (যেমন- কাওমারি, বড়চর, নয়ারহাট, অষ্টমির হাট ইত্যাদি) থেকে নিয়মিত চিলমারীতে চলাচল করে। এছাড়া প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে ৭০-৮০ টন পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়।

বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান নৌ প্রটোকলে চিলমারী একটি পার্ট অব কল হিসেবে চিহ্নিত। চিলমারী বন্দরটি অন্য পরিবহন মাধ্যম সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের উভয় তীরের জনগণের জন্য অন্যতম পরিবহন হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার প্রায় ৬০ লাখ মানুষের চাহিদার অনুপাতে বিশেষ করে চিলমারী এলাকায় বছরে পরিবাহিত প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার টন পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়। এসব পণ্য সুষ্ঠু ও নিরাপদভাবে আনা-নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন। চিলমারীকে নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং অন্য নদী ও সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে একে সংযুক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

সংশোধিত প্রকল্পে নতুন প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অগ্রাধিকারমূলক প্যাকেজগুলো বিবেচনা করে ক্রয় পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। প্রকল্পটি প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় এর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে অনুমোদিত প্রকল্পে দুটি গাড়ি কেনার সংস্থান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গাড়ি কেনাকাটায় সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সংশোধিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) গাড়ি ভাড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের জোড়গাছ এলাকার অংশ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে বাদ দেওয়ায় নতুন করে রমনা এলাকায় ৭ দশমিক ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।

যেসব কারণে প্রকল্প সংশোধনভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা: মূল প্রকল্পে ১১ দশমিক ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ অন্তর্ভুক্ত আছে। প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের মধ্যে রমনা এলাকায় ২ দশমিক ৫ একর, জোড়গাছ এলাকায় ৭ দশমিক ৫ একর, রাজীবপুর এলাকায় শূন্য দশমিক ৫ একর, রৌমারী এলাকায় শূন্য দশমিক ৫ একর, নয়ারহাট এলাকায় শূন্য দশমিক ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ হবে। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক অফিস থেকে ৪ ধারা নোটিশ জারি করা হয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা প্রশাসক অফিসের ফিল্ডবুক প্রস্তুত করে। জেলা প্রশাসক অফিস থেকে ফিল্ডবুক প্রস্তুতের পর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।

গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জোড়গাছ এলাকায় ৭ দশমিক ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের স্থানে বসবাসকারী জনগণ জেলা প্রশাসক বরাবর পুনর্বাসনের দাবি জানান। জেলা প্রশাসক কুড়িগ্রাম জোড়গাছ এলাকার ভূমি অধিগ্রহণের বিপরীতে পুনর্বাসনের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু অনুমোদিত ডিপিপিতে প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণের বিপরীতে পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রকল্পটির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা এবং অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি এবং জটিলতার সৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুন☞ চিলমারী থেকে প্রথমবার পণ্যবাহী জাহাজ যাচ্ছে ভারতেচিলমারী নৌবন্দরে প্রথমবারের মতো ভারতীয় কয়লাবাহী নৌযান

প্রকল্পের আওতায় রমনা এলাকায় আগের প্রস্তাবিত ২ দশমিক ৫০ একর ভূমির সঙ্গে জোড়গাছ এলাকার ৭ দশমিক ৫০ একর ভূমির পরিবর্তে রমনা এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ এবং প্রকল্পটি সংশোধন করার প্রস্তাব দ্রুত মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া জমির মূল্য ২০১৭ সালের দর অনুযায়ী ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা ছিল। মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে অধিগ্রহণ বাবদ প্রাক্কলিত ক্ষতিপূরণের অর্থ দ্বিগুণ দেওয়ার বিধান থাকলেও বর্তমানে তা ২০২৩ সালের দর অনুযায়ী বৃদ্ধি ও ক্ষতিপূরণ তিনগুণ হওয়ায় জমির দাম বেড়ে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা হয়েছে। ফলে এ খাতে ২১ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাড়তি প্রয়োজন।

রেট শিডিউল ও বাজার দর পরিবর্তনপ্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত পূর্তকাজের সব আইটেমের মূল্য ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছিল। বর্তমানে নতুন রেট শিডিউল ২০২২ প্রকাশিত হওয়ায় এবং অর্থ-মন্ত্রণালয় থেকে কতিপয় আইটেমের দর বাড়ানোর পরিপত্র জারি করায়, অনুমোদিত ডিপিপি মূল প্যাকেজগুলোর দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থান পরিবর্তনজনিত কারণে নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করতে বিলম্বের সৃষ্টি হয়। এছাড়া নতুন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কতিপয় প্যাকেজের আয়তন-ক্ষেত্রফল কমানো-বাড়ানো এবং বর্তমানে রেট শিডিউল ও পরিপত্র অনুযায়ী তার দর নির্ধারণ করে প্যাকেজগুলোর দর পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী পূর্তকাজের ব্যয় ২০৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী পূর্তকাজের ব্যয় বেড়ে ২৭৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা হয়েছে। প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত পূর্তকাজের সব আইটেমের মূল্য বর্তমান রেট শিডিউল অনুযায়ী নির্ধারণ করার ফলে মূল অনুমোদিত ডিপিপি থেকে ব্যয় বেড়েছে।’

এমওএস/এমএএইচ/এএসএম