ব্যস্ততম নগরী ঢাকায় আগুনে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না, বরং দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। একের পর এক ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। একটির ক্ষত শুকানোর আগেই আরেকটি অগ্নিদুর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যু। অগ্নিকাণ্ডে নিরীহ মানুষের প্রাণহানিতে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা করা হয়। এসব মামলাও থেকে যাচ্ছে অবহেলায়ই। দীর্ঘদিনেও শেষ হয় না বিচার। বিচার শেষ না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। আর প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
Advertisement
গত এক যুগে ঢাকায় অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড়োসড়ো অগ্নিদুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেমন হয়েছে, তেমনি স্বজন হারিয়ে পথে নেমেছে অনেক পরিবার। এর মধ্যে ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, ওই বছর বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন, কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ জন নিহত হন। ২০২১ সালে রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২ জন নিহত হন। এসব ঘটনায় অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হলেও সাক্ষী না আসায় এখনো বিচার শেষ হয়নি।
আরও পড়ুন• আগুনে মৃত্যুর শেষ কোথায়?• ৪৬ জনের মৃত্যু, অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে মামলা
সর্বশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে আগুনে ৪৬ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেছে পুলিশ। তদন্ত চলছে মামলাটির।
Advertisement
তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ১২ বছরে ১১ সাক্ষী
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন নিহত হন। আহত ও দগ্ধ হন আরও দুই শতাধিক শ্রমিক। পরদিন আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারা যুক্ত করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসিনুজ্জামান খান ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে তাজরীন ফ্যাশনের এমডি দেলোয়ারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান। মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে। মামলার ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ১১ জন।
Advertisement
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘মামলাটিতে সাক্ষীই আসে না। ১০৪ চারজন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১১ জন আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন।’
চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড: দুই বছরেও শেষ হয়নি বাদীর সাক্ষী, পাননি ক্ষতিপূরণ
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ (২ মার্চ)। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সেখানকার ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে আশপাশে আগুন ছড়িয়ে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পুরো এলাকা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৬৭ জন। ঘটনার পরদিন ওই এলাকার বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলেসহ আটজনের বিচার শুরু হয়েছে। তবে বিচার শুরুর এক বছরেও শেষ হয়নি মামলার বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ।
আরও পড়ুন• বেইলি রোডে আগুন: ভিডিওকলে ‘বাঁচার আকুতি’ জানিয়েছিলেন রকি• তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড মামলার সাক্ষ্য হয়নি
মামলার বাদী বলছেন, বিচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা। কোনো ক্ষতিপূরণও পাননি। অপরদিকে, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ও হাসানের আইনজীবীর দাবি, সবকিছু হারিয়ে ঘটনার ভিকটিম হয়েছেন তারা।
চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় চকবাজার মডেল থানায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সুলতান সোহেল ও মোহাম্মদ হাসান সুলতানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রায় তিন বছর তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাইয়ুম আট আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪, ৪২৭, ৩৩৬ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলাটি বিচারের জন্য ওই বছরের ২৮ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি হয়। চার মাস পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালত আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেন। একই সঙ্গে আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের পর ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর মামলার বাদী আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দেন। এখনো তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। আগামী ১৪ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
এফআর টাওয়ারে আগুন: পাঁচ বছরেও তিন মামলার কূলকিনারা হয়নি
পাঁচ বছর আগে ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৭ নিহত হন। এরপর এ ভবন নির্মাণে নানান অনিয়মের বিষয় বেরিয়ে আসতে থাকে। কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়েরে ওই ভবনের জমির মূল মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফআর টাওয়ার।
আরও পড়ুন• ‘কারখানায় প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় ভয়াবহ হয়ে ওঠে আগুন’• এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় মামলা
এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত বাদী হয়ে মামলা করেন। ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সূত্রধর আদালতে চার্জশিট দেন। এরপর মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। চলতি বছর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধিকতর তদন্ত শেষে আটজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।
এফআর টাওয়ারের নকশা জালিয়াতির অভিযোগে ভবন মালিক ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ চারজনের বিচার চলছে। ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ কামাল হোসেনের আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।
এদিকে রাজউকের ছাড়পত্র ইস্যু, ফি জমা, নকশা অনুমোদন না নিয়ে ভুয়া নকশা তৈরি করে এফআর টাওয়ারের ১৯ থেকে ২৩তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক, বিক্রি ও অগ্নিকাণ্ডে জনসাধারণের জানমালের ক্ষতির কারণে দুদকের উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ২৫ জুন কমিশনের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ আরেকটি মামলা করেন।
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণহানি
নকশা জালিয়াতির মামলায় ভবনটির মালিক সৈয়দ মো. হোসাইন ইমাম ফারুকসহ (এস এম এইচ আই ফারুক) ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ সৈয়দ কামাল হোসেন। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।
এছাড়া কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৭ জন নিহত হন। ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জন এবং একই বছর রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২ জন নিহত হন। এসব দুর্ঘটনায় মামলা হলেও এখনো কোনো কূলকিনারা হয়নি।
আরও পড়ুন• বেইলি রোডে আগুন লাগা ভবনের ম্যানেজার আটক• হাতে ঘড়ি দেখে মিনহাজের মরদেহ শনাক্ত করলো পরিবার
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলো সাক্ষীর পর্যায়ে রয়েছে। মামলায় কিছু সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন, আবার কিছু সাক্ষী আসেন না। সাক্ষী না আসায় মামলাগুলো শেষ করা যাচ্ছে না। সাক্ষীদের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সমন পাঠানোর পরও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব মামলায় যারা অপরাধী তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অসাবধানতা বা অবহেলার কারণে বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাফিলতির কারণে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আবাসিক এলাকার একটি ভবনে অর্ধেক রেস্টুরেন্ট আর অর্ধেক অ্যাপার্টমেন্ট করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। একটা ভবনে হয় পুরোপুরি কমার্শিয়াল হবে, না হয় পুরোপুরি অ্যাপার্টমেন্ট হবে। ভবনের মালিকরা লাভবান হওয়ার জন্য এমন করছেন। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। প্ল্যান দেওয়ার সময় রাজউকের এসব চিন্তা করা উচিত। যারা এসব ঘটনায় দায়ী তাদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলোর মধ্যে এখনো কোনো মামলার রায় হয়নি। এসব মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা।’
জেএ/ইএ/জেআইএম