অলোক আচার্য
Advertisement
দেখতে দেখতে একটি মাস পেরিয়ে গেলো। শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা। লেখক, পাঠক আর প্রকাশকের সম্মিলনে একটি মেলায় থাকে অসংখ্য স্মৃতি। বইমেলা হওয়ার কারণেও ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি মানেই রাজধানী ঢাকায় বইয়ের উৎসব। চারিদিকে নতুন বইয়ের গন্ধ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে এটি আর এখন কেবল একটি মেলা নয়। অনেক বইপ্রেমী সারাবছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাস এবং এ মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন। যতদিন যাচ্ছে ততই জমে উঠছে। বাঙালির প্রাণের বইমেলা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের এক মহামিলন মেলায় রূপ নেয়। এ শুধু বইমেলা নয়, এ এক প্রাণের মেলা। আত্মার সঙ্গে আত্মার যেমন সম্পর্ক, তেমনই বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক।
সাহিত্য হলো দেশের মননশীলতার প্রাণ। আর সাহিত্যচর্চার এবং বিকাশের অন্যতম কেন্দ্র হলো বইমেলা। লেখক ও পাঠকের মিলনমেলায় পরিণত হবে বইমেলা। নতুন বই, নতুন লেখক-কবির মিলনস্থল এ বইমেলা। পুরাতন পাঠকদের সঙ্গে যোগ হয় নতুন প্রজন্মের বইপড়ুয়ারা। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এবারের বইমেলা আমাদের কি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে গেল? বইমেলাও কি অযোগ্যদের দখলে চলে যাচ্ছে? এতসব প্রশ্ন সামনে আসছে। কারণ এ বইমেলায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ভাইরাল শব্দটি। এখানেও গিলে ফেলেছে অপসংস্কৃতির চর্চা। এখানেও গ্রাস করেছে রাহুর কালো ছায়া।
একটু বুঝিয়ে বলছি, যারা মানে যেসব লেখক বছরব্যাপী দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতায় লেখেন এবং পাঠ করেন; সেসব লেখক কবির কতজনের বই পাঠকরা লাইন ধরে কিনেছেন, বিষয়টি একটু খোঁজ নিলেই সব বোঝা যাবে। বেশিরভাগের বই বিক্রির অবস্থা আশানুরূপ নয়। তা আমরা কেউ স্বীকার করি আর নাইবা করি! প্রকাশকের মুখ দেখলেই তা বোঝা যায়। আবার কেউ কেউ নিজ দায়িত্ব নিয়েই কিছু বই বিক্রি করে দিচ্ছেন! কারণ প্রকাশক তো আর সব লোকসান দিবেন না। দৈনিক পত্রপত্রিকাতেও এসেছে এবার মূলধারার চেয়ে মূলধারার বাইরের লেখকের বইয়ের চাহিদাই বেশি। এ দোষ কার? আদতে কারো না। আবার সবারই। কারণ আজকাল ভাইরাল না হলে কিছুই চলে না। তাছাড়া মূলধারা আর মূলধারার বাইরের কথাটার মানে কী? আমি মনে করি, যারা নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করছেন, লিখছেন বিভিন্ন সাহিত্য পাতায় বা লিটল ম্যাগে সেগুলোই মূলধারা। বিপরীতে যারা এর বাইরে কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়েই তাদের কাজ সারছেন বা কবিতা লিখছেন বা অন্যকিছু করছেন সেসব মূলধারার বাইরে। তবে সেখানেও কিন্তু পাঠক আছেন এটা সত্য এবং তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
Advertisement
যেমন ধরেন, মাঝে মধ্যে যেসব গায়ক নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হন; তাদেরও ভক্ত জুটে যায়। যদিও তারা খুবই স্বল্পস্থায়ী আসনে আসীন থাকেন! কিন্ত ততদিনে গানের বারোটা বাজিয়ে চলে যান। সেভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু লেখক-কবি খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা তথাকথিত পপুলার কিন্তু তাদের সাহিত্য জগতে পদচারণা কম, তারাই বেস্টসেলার লেখকের তালিকায় চলে যাচ্ছেন বা যাবেন বলে অনুমান করা যায়। এভাবে চলতে থাকলে সাহিত্যও তার জায়গা থেকে সরে যাবে। বলা যায় মুখ থুবড়ে পরবে। এমনিতেই দেশে পাঠকের সংখ্যা কমছে। বইমেলায় বইয়ের ক্রেতা থাকেন হাতেগোনা। দর্শকই যান বেশি। এখন কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, যারা সাহিত্য পাতা বা লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিতভাবে লিখছেন; তারাই কি কেবল লেখক? উত্তর হলো, হ্যাঁ। ঠিক তাই। সারাবছর যারা সাহিত্যচর্চা করেন না, তারা পাঠককে কিছু দিতে পারেন এ আমি বিশ্বাস করি না। আর সাহিত্য পাতাগুলো যারা সম্পাদনা করেন, তারা মানসম্মত না হলে লেখা ছাপেন এটা তো বলা যায় না। মুখ চিনে লেখা ছাপানোর যে অভিযোগ আছে, সেটাও দুয়েকটা ছাড়া সবাই ভালো লেখা হলেই ছাপেন। কিন্তু আমাদের বইমেলা যদি ভাইরালদের দখলে চলে যায়, তাহলে লেখালেখির যে বারোটা বাজবে বা বলা যায় অলরেডি বেজে গেছে; সে বিষয়ে অনেকেই একমত হবেন বলে আশা করি। কেউ কেউ তো পরের বার বইমেলার আগে ভাইরাল লেখক কীভাবে হওয়া যায় সেই নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় ব্যস্ত! সেটা না করেইবা কী হবে? যারা মৌসুমি প্রকাশক নন, তারা তো এসব উঠতি সম্ভাবনাময় লেখকের লেখা প্রকাশ করেন। তো দিন শেষে যদি তাদের বই বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তুলতে না পারেন, তাহলে বই প্রকাশ করবেন কেন? এটা তো তাদের রুজি রোজগারের বিষয়। এবার দুটি শব্দ বেশ আলোচিত হয়েছে। তা হলো মৌসুমি লেখক আর মৌসুমি প্রকাশক। এ দুয়ের ঠেলায় অস্থির বইমেলা! দেখা গেলো দিন শেষে তাদের প্রকাশিত বইয়ের বিক্রিই বেশি!
আরও পড়ুন• ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচ্ছদের কাজ করা যায় না• সঠিক সময়ে সঠিক প্রচার জরুরি: সাজ্জাক হোসেন শিহাব
একটি বইমেলা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা জোগায়। তার গতি উল্টো দিকে বইলে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে তা মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কারণ বইমেলার কেন্দ্রবিন্দু হলো বই। বইমেলায় গত কয়েক বছর ধরেই কবিতার বইয়ের বিক্রিবাট্টা কম। কবিতার পাঠক কম। অথচ কবির সংখ্যা বাড়ছে। তবে কবিতার পাঠক কেন কমছে বা কম বা কবিতার বইয়ের বিক্রি কম, সে উত্তর কিন্তু আজও পাইনি। নতুন পুরাতন লেখক কবি প্রকাশক মেলার দর্শক সবাই উপস্থিত হন। বইমেলায় আসা থেকে শুরু করে বই বিক্রি করাই শেষ কথা নয় অথবা মেলার সার্থকতা নয়। মিলনমেলায় সবাই একত্রিত হওয়াটাও উদ্দেশ্য। বইমেলা এলেই পাঠক-লেখক আর প্রকাশকদের নিয়ে তৈরি হয় অন্যরকম এক অনুভূতির জায়গা। সরগরম থাকে মেলাপ্রাঙ্গণ। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বইপ্রেমীরা প্রিয় লেখকের বই কেনার জন্য ছুটে আসেন মেলায়। এ এক আত্মিক বন্ধন। এই বন্ধন গড়ে ওঠে বইমেলাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এতসবের ভিড়ে বইয়ের বিক্রিটাই মুখ্য। কারণ বই বিক্রি না হলে শুধু শুধু বই প্রদর্শনী করে কী লাভ? এ জন্য তো আর স্টলগুলো এত টাকা খরচ করবে না।
সেই বিক্রির পথটা এখন আলাদা। ভাইরাল লেখক, ভাইরাল প্রকাশক এবং মেলা! এসব না হলে আজকাল বই চলে না! আর সোজা বাংলায় বললে পাঠক খায় না! পাঠককে বই পড়ানো নয়, খাওয়াতে হয় আজকাল! নতুন বই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। নতুন লেখক বইমেলা কেন্দ্রীক। এমনকি বই কেনাটাও সেই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। সারাবছর কোনো নতুন বইয়ের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বইমেলা এলেই বই প্রকাশের হিড়িক লেগে যায়। এত লেখক, কবি বা প্রকাশক যে কোত্থেকে আসে ভাবাই যায় না। অথচ সারাবছর আমরা যাদের লেখা পড়ি তারা কমই থাকেন বইমেলায়। সাহিত্যে তাঁদের অবদানটাই বেশি থাকে। বই প্রকাশের গতি কেবল বইমেলা কেন্দ্রীক হওয়ায় এখনো টিকে থাকা পাঠকরা তাই সারাবছর অভুক্ত থাকেন। তাছাড়া গত কয়েক বছরে এমন কোনো লেখক পাঠকমহলে সাড়া ফেলতে পারেননি, যার বইয়ের টানে পাঠকমহল ছুটে আসে। যার বইয়ের খোঁজ সারাবছর নেয় পাঠকরা।
Advertisement
প্রকাশনা সংস্থাগুলো তাদের বিনিয়োগের সিংহভাগই বইমেলার জন্য রেখে দেন। সারাবছর কোনোমতে টিকে থাকা এই প্রকাশনা শিল্প যেন প্রাণ ফিরে পায় বইমেলা এলে। মুদ্রণশিল্প, ডিজাইনিং সব শাখার কর্মীদের জন্য বেড়ে যায় ব্যস্ততা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখক নিজের টাকা দিয়ে বই বের করেন। অনেক লেখক কবি প্রতি বছর বই বের করেন। তারা আদৌ কোনো পাঠক শ্রেণি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ। নিজের বই নিজেকে বহু কষ্টে বিক্রি করতে হচ্ছে। লাইন দিয়ে কিনছে ভাইরাল লেখকের বই। হাতেগোনা কয়েকজন লেখক আজ পাঠক টানতে পারছেন। তাই সাহিত্যের মান রক্ষা করাটা জরুরি। সাহিত্যও যদি আমাদের চলচ্চিত্র জগতের মতো মুখ থুবড়ে পরে, তাহলে বাঙালির দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। যারা লেখালেখির জগতে নতুন। তাদের একটা বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন সাহিত্য বিষয়টা নিয়মিত চর্চা করে। হুট করে বই প্রকাশ করার চেয়ে সময় নিয়ে লেখালেখিতে আরও মজবুত ভিত্তি করে তারপর প্রকাশে যাওয়া উচিত। সাহিত্যচর্চায় ধৈর্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত চর্চা ছাড়া যেমন কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়; তেমনই সম্ভব নয় সাহিত্যেও। সব মিলিয়ে এবারের বইমেলায় ভাইরাল শব্দটি বেশ আলোড়িত ছিল। এভাবে ভাইরাল হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা পাছে বইমেলাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে সেই দুশ্চিন্তাই বড় বিষয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএসএম