শফিক রিয়ান এ সময়ের পরিশ্রমী লেখক। তার উপন্যাস ভালো লাগে। বইমেলায় যে কয়দিন তার স্টলে গিয়েছি, ভিড় দেখে অবাক হয়েছি। মানুষ আগ্রহ নিয়ে শফিক রিয়ানের বইটি কিনছে। শফিককে বলেছি, ভালো লেখক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো মানুষ হওয়াও জরুরি। মানুষ হিসেবেও তিনি চমৎকার। সেই চমৎকারিত্বও ফুটে ওঠে তার লেখায়। শফিক রিয়ানের এবার বইমেলায় প্রকাশিত উপন্যাসের নাম ‘বিষাদের ছায়া’। বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ এসেছে দুয়ার প্রকাশনীর স্টলে।
Advertisement
‘বিষাদের ছায়া’ শফিক রিয়ানের তৃতীয় উপন্যাস ও পঞ্চম বই। এর আগে ‘আজ রাতে চাঁদ উঠবে না’ (২০২১), ‘মেঘ বিষাদের দিন’ (২০২২), ‘বিধ্বস্ত নক্ষত্র’ (২০২২) ও ‘নিষিদ্ধ করে দাও সূর্যাস্ত’ (২০২৩) বইগুলো প্রকাশ হয়। বরাবরের মতোই মুন্সিয়ানার ছাপ রয়েছে তার লেখায়। পাশাপাশি কবি ও নির্মাতা হিসেবে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত শফিক রিয়ান। ফলে বাংলা সাহিত্যে আগামী দিনে নিজস্ব বলয় তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস।
সে যা-ই হোক, বইটি সংগ্রহ করে আগ্রহ নিয়েই পড়লাম। ‘বিষাদের ছায়া’র গল্প সরল। প্রেক্ষাপট চিরচেনা। পরিবেশ ও পরিস্থিতি আশপাশের। উপন্যাসটি ভালোবাসা এবং আত্মীয়তার জটিলতা নিয়ে লেখা। শফিক রিয়ান সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণিকে তুলে ধরেছেন। আমাদের চিরচেনা মধ্যবিত্ত পরিবারিক জীবন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অস্থিরতা, প্রেম এবং সম্পর্কের গভীরতা উপন্যাসের মূল উপজীব্য। লেখক প্রতিটি চরিত্রকে ঢেলে সাজিয়েছেন। প্রতিটি চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাতে চরিত্রের উপস্থিতি যতটুকুই হোক না কেন?
শফিকের উপন্যাসের ভাষা সহজ-সরল ও সাবলীল। কঠিনতম বিষয়গুলোও লেখক সহজ ও প্রাঞ্জল করে উপস্থাপন করেছেন। কখনো কখনো হাস্যরসের উপস্থিতি কাহিনিতে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। চরিত্র বিশ্লেষণেও যত্নের ছাপ রেখেছেন। আধুনিকতা, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জকে সংগতিপূর্ণ অবস্থানে আনতে সক্ষম হয়েছেন। শব্দচয়ন, বানান এবং ভাষাশৈলী লেখার মাধুর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে কিছু কিছু ত্রুটি এড়িয়ে যেতে পারলে আরও গতিশীল ও প্রাণবন্ত হতে পারতো। তবে উপন্যাসের প্যারাগুলো আরেকটু ছোট হলে ভালো লাগতো। পড়তে সুবিধা হতো। কেননা লেখকের নিজস্ব স্টাইলও থাকা জরুরি।
Advertisement
প্রথম দেখাতেই উপন্যাসের প্রচ্ছদটি দারুণ লেগেছে। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা পরিচিত এক সাধারণ পরিবারের সন্ধান পাই। যেখানে পারুল ও তার মা দিলশাদকে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া পারুলের ফুফু রওশন আরা, মুহিত, বদরুল, মোসাম্মৎ খোদেজা খাতুন, মুহিতের লিটু মামা, মামি রাহানা, ডিরেক্টর বাদল, সহযোগী ফুল মিয়া, টগর ও শফিকরা কাহিনিকে টেনে নিয়ে গেছেন পরিণতির দিকে। সেসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে দ্বিতীয় বিয়ে, পরিবারিক চিত্র, কর্পোরেট জীবন, চাকরি ছেড়ে সন্ন্যাসী হওয়া প্রভৃতি গল্প।
আরও পড়ুন• কাব্যশৈলীর কতিপয় দিগন্ত: পাঠ ও প্রতিক্রিয়া• অর্জুন বিশ্বাস: জীবনছোঁয়া গানের মানুষ
পারুলের জীবন কাহিনি আমাদের পরিচিত চিত্রই ফুটিয়ে তুলেছে। পারুলের ভাবনা এবং মুহিতের মনোভাব তুলে ধরা লেখকের উদ্দেশ্য হলেও তাদের আত্মত্যাগ ও সম্পর্ক পাঠককে ভাবাবেই ভাবাবে। জীবন-যন্ত্রণা কাহিনিকে আলোকিত করেছে। পাঠককে আলোড়িত করেছে। ফলে কাহিনির পরতে পরতে মধ্যবিত্তের বাস্তব জীবনের আবহ লক্ষ্য করা যায়।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পারুল। এই পারুলের সঙ্গে মিলে যাবে অনেকের জীবন। তবে নারীপ্রধান চরিত্র বলেই কি বইটি পাঠকের আগ্রহ কাড়তে সক্ষম হয়েছে? হয়তো পাঠক নিজের চরিত্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। পাবেন ছোটবেলার অনেক স্মৃতি। মায়ের ভালোবাসার কথা স্মরণ হবে পলকেই। এ ছাড়া খোদেজা খাতুনের মৃত্যু কষ্টের মনে হবে। তার মৃত্যুর পরে লিটু মামার কী হয়েছিল? প্রশ্নটি থেকে যাবে পাঠকের মনে।
Advertisement
এমনকি বইয়ের নাম কেন বিষাদের ছায়া—এ কথাও উঠবে। তবে কোথাও কি বিষাদ খুঁজে পাওয়া যাবে? হয়তো পাওয়া যাবে। শেষ মুহূর্তে পারুল কেন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটালো? দিন শেষে ভালোবাসার মানুষের কাছে আশ্রয় নিলে হয়তো সুন্দর সমাপ্তি হতো। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা এখানেই। সব পরিণতিই সুন্দর হয় না। পারুলের শেষ পরিণতি জানলেই এই নামের অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে। উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা এখানেই।
এ কথা সত্যি যে, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জীবনের টানাপোড়েন তো থাকবেই। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়; সেখানে বিলাসিতা কি মানায়? তাই তো উদাসীন মুহিতের প্রতি পাঠকের রাগ হতেই পারে। তখনই হয়তো চরিত্রটি বাস্তব জীবনকে স্পর্শ করতে পারে। তবে ফুল মিয়ার চরিত্রটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও একটু নির্মল আনন্দ এনে দিতে পারে। সবমিলিয়ে উপন্যাসটি আমার ভালো লেগেছে। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি। শফিক রিয়ানের জন্য শুভ কামনা।
বইয়ের নাম: বিষাদের ছায়ালেখক: শফিক রিয়ান বইয়ের ধরন: উপন্যাস প্রচ্ছদ: সাহাদাত হোসেনপ্রকাশনী: দুয়ার প্রকাশনী মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা।
এসইউ/এএসএম