সাততলা ভবন। একটি ছাড়া সব তলাতেই রেস্টুরেন্ট। এরমধ্যে বড় রেস্টুরেন্ট তিনটি। তিন রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিলেন অন্তত হাজারখানেক মানুষ। এছাড়া একই ভবনে একটি বিখ্যাত পাঞ্জাবির দোকান, মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের একাধিক শোরুম। অভিজাত এলাকার অভিজাত ভবনে সবই ছিল। ছিল না কেবল নিরাপত্তা। লিপ ইয়ারকে স্মরণীয় করে রাখতে হাজারখানেক মানুষ যখন খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত, হঠাৎ করেই তখন ছড়িয়ে পড়লো আগুন। দুই ঘণ্টার মধ্যেই ঝরে গেলো অন্তত ৪৩টি তাজা প্রাণ। হাসপাতালে ছটফট করছেন আরও অন্তত ১২ জন।
Advertisement
সব যখন শেষ, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক তখন সাংবাদিকদের বললেন, ‘ভবনটি ছিল বিপজ্জনক। প্রতিটি ফ্লোরেই গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল। এমনকি সিঁড়িতেও ছিল।’
মাসের শেষ দিন, সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের রাতের এ ভয়াবহতা চরম দাগ কেটে গেছে সাধারণ মানুষের মনে। প্রশ্ন হলো, এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরে কেন জানা গেলো, ভবনটি নিরাপত ছিল না? ফায়ারের ডিজি যাকে ‘বিপজ্জনক’ ভবন বলেছেন, তেমন ভবন কি ওই একটিই নাকি পুরো শহরটাই এমন?
এ আগুনের খবর দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, গার্মেন্টসের বাইরে অন্যান্য শিল্পগুলো বাংলাদেশের স্থানীয় অর্থনীতিকে যে হারে ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করছে, সে হারে এসব খাতে নিরাপত্তায় জোর দেওয়া হচ্ছে না। ফলাফল হিসেবে গত কয়েক বছরে আগুনে প্রাণ গেছে শতশত মানুষের।
Advertisement
রয়টার্সের খবরের সূত্র ধরে আমরা চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, পুরো শহরে চালু হয়েছে হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্টুরেন্টের মধ্যে যারাই নাম করেছে, তারাই খুলেছে একাধিক শাখা। বেইলি রোড থেকে খিলগাঁও, উত্তরা থেকে ধানমন্ডি, বাড্ডা থেকে পুরান ঢাকা- সবখানেই দেখা যায় একই চিত্র। এ রেস্টুরেন্টগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
নগরজীবনে যেখানে আমাদের নিশ্বাস নেওয়ার মতো খালি জায়গা পাওয়া যায় না, সেখানে রেস্টুরেন্টগুলোই হয়ে উঠেছে আমাদের আড্ডাখানা। সেখানকার কর্মীরা হয়ে উঠেছেন আমাদের আপনজন। যেখানে গিয়ে গা এলিয়ে কিছু সময় আড্ডা দেওয়া যায়। নিজের স্বাদের সঙ্গে মিলিয়ে খাওয়া যায় মুখরোচক খাবার। সেখানেই এমন মৃত্যু যন্ত্রণা!
প্রায় সব এলাকাতেই রেস্টুরেন্টগুলো গড়ে উঠেছে পাশাপাশি। অনেকটা রেস্টুরেন্টের ‘হাট’ বসার মতো। আবার সব এলাকাতেই এমন কিছু ভবন নতুন করে তৈরি হয়েছে, বা পুরাতন ভবনকে সংস্কার করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে ওই ভবনের সবগুলো তলাতেই হয়েছে রেস্টুরেন্ট।
বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ ভবন পুড়ে শেষ হওয়ার পর আমরা জানলাম সেটি ছিল ‘বিপজ্জনক’। বাকি ভবনগুলো কি বিপদমুক্ত?
Advertisement
এ নিয়ে নিজের আশঙ্কার কথা লিখেছেন আমারই সাবেক সহকর্মী জেসমিন পাপড়ি। নিজের ফেসবুক আইডিতে তিনি বর্ণনা দিয়েছেন ধানমন্ডির একটি ভবনের। পাপড়ি লিখেছেন, ‘ধানমন্ডিতে ৯ বা ১০ নম্বরে একটি বড় বিল্ডিং আছে। সেখানকার প্রায় সব ফ্লোরে রিরাট সব রেস্তোরাঁ। হাজার হাজার মানুষ সেখানে হুমড়ি খেয়ে যায়। নেমন্তন্ন খেতে ২ বার গিয়েছিলাম। শুরুতেই লিফটে উঠতে বিরাট লম্বা লাইন ধরতে হবে। নামার অবস্থা আরও খারাপ। সেদিন ফেরার সময় খুব খুব তাড়া ছিল আমার। ভাবলাম সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি। কিন্তু গিয়ে দেখি সিঁড়িগুলো বলা যায় অন্ধকার! ব্যবহার দূরে থাক, সম্ভবত বছরের পর পছর পরিষ্কার করে না। ... বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে বহুবার বলেছি, বড় একটি বিপদ এই রেস্তোরাঁতে না হওয়া পর্যন্ত কেউ সচেতন হবে না! আমার সে আশঙ্কা সত্যি হলো। ধানমন্ডি বাঁচলেও বেইলি রোড পুড়ে ছারখার!...’
বৃহস্পতিবার রাতের এ আগুনের খবর দিয়ে জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে লিখেছে, ‘নিরাপত্তার অভাবে কারখানা এবং বাসভবনে আগুনের ঘটনা বাংলাদেশে নিয়মিত এবং কুখ্যাত হয়ে উঠেছে।’
এই যখন আমাদের অবস্থা, তখন কি আমরা সচেতন হবো? শহরজুড়ে গড়ে ওঠা হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট, যেখানে নাগরিকরা প্রিয়জনদের নিয়ে যান একটু ‘ভালো সময়’ কাটাতে, সেগুলো কি ভালোই থাকবে? নাকি বেইলি রোড ট্র্যাজেডির মতো আরও কোনো ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে?
লেখক: সাংবাদিক
এইচআর/এমএস