সুইডেনের গোথেনবার্গের আকাশটি জ্বলন্ত আগুনের ধোঁয়ার কারণে কালো হয়ে গেলো। শহরের মাঝখানে লিসেবার্গের ওসিয়ানা বিনোদন পার্কটি আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো। সঙ্গে ঘটে গেলো কয়েকটি বিস্ফোরণও। লিসেবার্গের নতুন স্নানঘর পুরোপুরি ধ্বংস হলেও দমকল বাহিনীসহ কর্মরত ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের ২২ জনকেই সুস্থ শরীরে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
Advertisement
সুইডিশ বিনির্মাণকারী কোম্পানি এনসিসির তথ্যানুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে কর্মরত মুহূর্তে অগ্নিসূত্রপাত ঘটে। শত কোটি সুইডিশ অর্থের বিশাল ক্ষতি হয়ে গেলো অতি অল্প সময়ের মধ্যে। মর্মান্তিক আগুনে শহরটি পুড়তে দেখে মনে পড়ে গেলো সেই ছোটো বেলার ঘটনাটি যেদিন পাক হানাদার বাহিনী আমাদের সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালের সেই আগুন কেউ নেভাতে সেদিন আসেনি, এমনকি চেষ্টাও করেনি।
চোখের সামনে একটি বাজার আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন পাক হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান, তথা আজকের বাংলাদেশের একদল বাঙালি যাদের একটি নাম ছিল ‘রাজাকার’। পাক হানাদার বাহিনী এবং রাজাকারদের বুক কাঁপেনি সেদিন। দেশ স্বাধীন করতে হবে যেকোনো মূল্যে। শুধু বাজার কেন পুরো গ্রাম জনশূন্য করে ফেলেছিল। জীবন বাঁচাতে হবে, দেশ স্বাধীন করার জন্য, এ যেন বাজিমাত।
ছোট, বড়, নারী, পুরুষ সবার মুখে একটিই বুলি-স্বাধীন কর স্বাধীন কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আমি সেই বাংলাদেশের কথা বলছি যে বাংলাদেশ আমার অহংকার। সেই অহংকার আজ লজ্জা, ঘৃণা, দুর্নীতি এবং প্রতারণায় ভরা। ‘ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ? - ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি —এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।’ আমি আমার সেই জন্মভূমির কথা বলছি।
Advertisement
গত কয়েক দিন আগে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের খবর দেখলাম। ২৪ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তান সেখানেও মোটামুটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। ভোটারদের ভোট দেওয়ার ধরণ নির্বাচনী বিশ্লেষকদেরও অবাক করেছে।
জাতীয় নির্বাচনের এক মাস আগেও বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই পিএমএল-এন ক্ষমতায় আসছে। এতে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন ৭৪ বছর বয়সী বর্ষীয়ান রাজনীতিক নওয়াজ শরীফ। এর বড় কারণ, একটা সময় পাকিস্তানে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর চক্ষুশূলে পরিণত হওয়া নওয়াজ এবারের নির্বাচনে ছিলেন জেনারেলদের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’।
নওয়াজ ও তার দলও জয়ের ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রস্তুত করে রাখা ‘বিজয় ভাষণ’ দিয়ে দেন তিনি। এরপর ভোটের ফল আসতে থাকলে ‘পাশার দান’ উল্টে যেতে থাকে।
দেশে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারে এসেছিলেন ইমরান। কিন্তু ক্ষমতায় বসার অল্প দিনের মধ্যেই গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন তিনি। কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কার সঙ্গে নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি বাড়তে থাকে। পাশাপাশি নিজের মিত্রদের সঙ্গেও তার মতভিন্নতা দেখা দেয়।
Advertisement
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও ইমরানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ২০২১ সালের অক্টোবরে নতুন গোয়েন্দা প্রধান নিয়োগ নিয়ে ইমরান নেতৃত্বাধীন সরকার ও সেনা নেতৃত্বের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
২০২২ সালের ১০ এপ্রিল ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত ১২টা ছোঁয়ার পরপরই ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এবার ইমরান খানের প্রতি ভোটারদের এই রায় পাকিস্তানের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পুরো ঘটনাটি দেখা এবং জানার পর ভাবনায় ঢুকেছে অভাগা বাংলাদেশ, যেখানে দুর্নীতি দেশের ভোটকেন্দ্রকেও গ্রাস করে ফেলেছে এবং দেশের মানুষ এখন আর ভোট দিতে যায় না, ভোট হয়ে যায়।
কারণ কী জানেন? দেশভরা নেতা অথচ সৎ এবং আদর্শবান নেত্রীত্বের অভাব, এটাই মূল কারণ। ভরি ভরি নেতা আছে কিন্তু নেতার অনুসারী নেই। নেতা তার মনুষ্যত্ব, লজ্জাশরম এবং বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। নেতা বলছে কী করতে হবে কিন্তু কে কার কথা শোনে। জনগণ বুঝে গেছে নেতাকে নেতৃত্বের সুযোগ করে দিলে সে করবে পরিবর্তন নিজের এবং তার পরিবারের।
সেক্ষেত্রে জনগণের কী হবে? হয়তো সবাই বলবে তাহলে মিটিংয়ে নেতার বক্তব্য শুনতে এতলোক জড় হয় কেন? মওলানা মিজানুর রহমানের ওয়াজ শুনতেও জনগণ যায়, তার অর্থ এই নয় যে তিনি যা বলছেন জনগণ সেভাবে কাজ করছে। জনগণ স্ট্রিট স্মার্ট, তাই তারা চোখ কান খোলা রেখে সব শুনছে, দেখছে এবং তারপর তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে।
লন্ডন বা ঢাকার লাক্সারি পরিবেশে বসে যেসব নেতা অর্ডার করছে কী করতে হবে তাদের কথা কেউ আর শুনছে না। বর্তমানে ক্ষমতায় যে সরকার তার কথাও জনগণ শুনছে না। সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা তাদের রুটিন অনুযায়ী কাজে হাজিরা দিচ্ছে মাত্র।
দেশের রাজনীতিতে শুধু ধান্দাবাজি, যার কারণে নেতার পেছনে কোনো অনুসারী নেই, আছে শুধু চামচা। অনেকে বড় বড় বক্তব্য করছে যেমন ‘অসহ্য এ সরকারের পরিবর্তন আনতে হবে, অনেকে সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, দেশে আজ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মধ্যে একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। তাদের এগিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার যেভাবে দেশ চালাতে চাচ্ছে, সেটা আর পারবে না। মানুষ একদিন দাঁড়িয়ে বলবে, এটা একেবারে অসহ্য হয়ে গেছে। এর পরিবর্তন আনতে হবে ইত্যাদি।’ এখন কথা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
জনগণ? জনগণ তো এখন আগের মতো বোকা নয়, যখন যার যা খুশি বলবে আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেদিন গুজার গিয়া। একটি গানের কলি মনে পড়ে গেলো ‘দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও।’ কই দেশের প্রতি যদি সত্যিই এত দরদ তাহলে ১৯৫২ সালের সেই শহীদ ভাইদের মতো করে কেন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছি না?
কারণ আমরা জনগণ বারবার শুধু জর্জরিত, শোষিত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত। আমাদের ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। হতাশায় নিমজ্জিত আমাদের সমস্ত শরীর। মন বলে শোষণ, শাসন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার হই আর ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু না তা করব না কারণ আমরা শান্তিপ্রিয় শান্ত জনগণ।
আমরা এখন ভিতু হয়ে গেছি, প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি আর অপমান সইতে শিখেছি। নীতিহীন এবং পথভ্রষ্ট নেতার নেতৃত্বের কারণে আমরা এখন নিজের দেশে পরাধীন। আমাদের নেতা আছে তবে নেই নেতৃত্ব। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা রক্ষার মাস, ফেব্রুয়ারি মাস শহীদের রক্তে রঞ্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি! এতসব কিছুর পরেও, দূরপরবাসে, হৃদয়ে বাংলাদেশ আজও ভাসে —সালাম সালাম হাজার সালাম শহিদ ভাইয়ের স্মরণে। আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাদের স্মৃতির চরণে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জেআইএম