স্বাস্থ্য

বছরের শুরুতেই চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশা

☞ চলতি বছর এডিস মশার উপদ্রব দ্বিগুণ বাড়বে☞ এডিস মশা নিধনে জনসম্পৃক্ততা জরুরি: কীটতত্ত্ববিদ☞ ঢাকায় ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স, আর এক শতাংশ এডিস মশা

Advertisement

চলতি বছরের শুরুতেই চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশা। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। কিন্তু মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিশেষ কোনো কার্যক্রম নেই।

২০২৩ সালে ঢাকা শহরে এডিস ও কিউলেক্স মশা উপদ্রব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গত বছর ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসেবে লাখ ছাড়িয়েছে। আর এ রোগে মারা গেছেন দেড় হাজারের বেশি। এবার বর্ষা মৌসুমে এডিস পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা।

‘ডেঙ্গু মোকাবিলা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। মশার উপদ্রব এ শহরের একটি সমস্যা। এ সমস্যা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। এবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না। তবে, এডিস মশা যেহেতু নাগরিকদের বাসাবাড়ির আঙিনায় হয়, তাই তাদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’ — ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম

Advertisement

কীটতত্ত্ববিদদের দাবি, প্রকৃতপক্ষে গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারের হিসাবের দ্বিগুণের বেশি হবে। এবার এডিস মশায় আক্রান্তের হার আরও বাড়তে পারে। গত বছর যেসব স্থানে এডিস মশা ডিম ছেড়েছে, সেসব স্থানে বৃষ্টির পানি জমা মাত্রই এডিস মশা জন্মাবে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশনকে আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পাশাপাশি কোনো ভবনের ছাদ বা আঙিনায় যাতে বৃষ্টির পানি জমা না থাকে, তা নাগরিকদের আগেই নিশ্চিত হতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার ১৮টি সরকারি হাসপাতালে ৩৪২ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালে ১১২ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই ঢাকার বাসিন্দা।

এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটিতে বর্ষা-পরবর্তী এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। এ জরিপে উত্তর সিটির ৪০টি ও দক্ষিণের ৫৯টি ওয়ার্ডে মোট তিন হাজার ২৮৩টি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ডিএসসিসিতে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ডিএনসিসিতে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ি ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকি পেয়েছে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা।

আরও পড়ুন☞ এবার আগেভাগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশঅনুমতি পেলে তিন মাসে আসতে পারে ডেঙ্গুর টিকাআগামীতে সিটি করপোরেশন নিজেই বিটিআই আমদানি করবে: আতিক

Advertisement

২০২২ সালের বর্ষা-পরবর্তী জরিপে উত্তরে শতকরা ৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও দক্ষিণ সিটি এলাকায় ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীটের উপস্থিতি পাওয়া গিয়ে ছিল। সেই হিসেবে ২০২২ সালের বর্ষা-পরবর্তী সময়ের চেয়ে ২০২৩ সালে তা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।

মশা নিধনে যা করছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসিরাজধানীর ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ড। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেটে নগরীতে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কিনতে ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছিল ৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

‘এডিস ও কিউলেক্স মশার চরিত্র বদলে গেছে। ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে স্থায়ী। সারা বছরই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হবে। এটি আর শূন্যতে নামানো যাবে না। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ জন্য বছরব্যাপী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।’ — জাবি অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার

গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগর ভবনে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের বছরব্যাপী প্রস্তুতি এবং করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ডিএনসিসি। এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ডিএনসিসিকে বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনায় নানান পরামর্শ দেন তারা। সে অনুযায়ী ডিএনসিসি কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ।

জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। মশার উপদ্রব এ শহরের একটি সমস্যা। এ সমস্যা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। এবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না। তবে, এডিস মশা যেহেতু নাগরিকদের বাসাবাড়ির আঙিনায় হয়, তাই তাদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’

গত বছরের ২৩ জুলাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে ডিএনসিসি। সমঝোতার আওতায় ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা এবং মশার ঘনত্ব ও প্রজাতি পরীক্ষা করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে। আর পরীক্ষার মাধ্যমেই মশা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ ও যে কোনো ডিভাইসের ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন☞ ডেঙ্গুতে ১৩ মাসে ১৭২১ মৃত্যু: সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীডেঙ্গু নিধনে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে ডিসিদের নির্দেশডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে সেটা বলা যাবে না: তাজুল

এ গবেষণা কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। সম্প্রতি তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এডিস ও কিউলেক্স মশার চরিত্র বদলে গেছে। ফলে ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে স্থায়ী। অর্থাৎ সারা বছরই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হবে। এটি আর শূন্যতে নামানো যাবে না। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ জন্য ডিএনসিসিকে বছরব্যাপী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

‘চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গুরোগী নেই বললেই চলে। আমরা পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, এবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এখন পর্যন্ত কিউলেক্স মশা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এখন খুবই কম।’— ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা

ডিএনসিসির মতো ডিএসসিসিও বছরজুড়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোসহ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে। এখন এডিস মশা নিয়েও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে, ডিএনসিসির তুলনায় তাদের কর্মসূচি বা কার্যক্রম কম দেখা গেছে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, গত ডিসেম্বরই বর্ষা-পরবর্তী এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপের রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। সে অনুযায়ী আমরা দক্ষিণ সিটির চিহ্নিত এলাকাগুলোতে অভিযান চালিয়েছি। এখন সেখানে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গুরোগী নেই বললেই চলে। আমরা পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, এবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া এবার এখন পর্যন্ত কিউলেক্স মশা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এখন খুবই কম।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এখন ঢাকায় ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স মশা আছে, আর ১ শতাংশ এডিস মশা আছে। এই ১ শতাংশ এডিস মশাই জনস্বাস্থ্যে সমস্যা তৈরি করে। তাই কিউলেক্স মশা ও ডেঙ্গু মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলতে হবে। আর এ কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া এডিস মশা নিধন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এমএমএ/এমএএইচ/এএসএম