খেলাধুলা

কাজ শেষ হওয়ার আগেই উদ্বোধন, বুঝে পায়নি কর্তৃপক্ষ

তরুণদের মাদকের পথ থেকে ফিরিয়ে খেলার মাঠে আনার চিন্তা থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি উপজেলায় উম্মুক্ত মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সরকার প্রধানের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ‘উপজেলা পর্যায়ে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প তৈরি করে তা ৪ ধাপে বাস্তবায়ন করছে। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের ১২৫ টি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ শেষ হয়েছে। চলছে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের কাজ। দ্বিতীয় ধাপের ২৫ স্টেডিয়াম এরই মধ্যে উদ্বোধন করা হয়েছে।

Advertisement

শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম প্রকল্প বাস্তবায়নের সরকারী চিত্রের সঙ্গে অনেকাংশেই মিল নেই বাস্তবতার। কোথাও মাঠ তৈরি করা হয়েছে; কিন্তু সেই মাঠ খেলার উপযোগী নয়, কোথাও নেই রক্ষণাবেক্ষণ। কোথাও মাঠ দখলে রয়েছে রাখালদের, খেলার কোনো বালাই নেই সেখানে। মিনি স্টেডিয়ামের জন্য যে সব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে, সে সবের অবস্থাও শোচনীয়।

জাগোনিউজের পক্ষ থেকে খোঁজ নেয়া হয়েছে সারা দেশে বাস্তবায়নরত এই মিনি স্টেডিয়াম প্রকল্পের। ধারাবাহিকভাবে সেগুলোই তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয় পর্ব পড়ুন এখান থেকে। আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব।

দ্বিতীয় ধাপের যে ২৫টি স্টেডিয়াম এরইমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে, তার একটি রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায়। স্টেডিয়াম উদ্বোধন হয়ে গেলেও কাজ এখনো বাকি। যে কারণে, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এ স্টেডিয়ামটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি স্থানীয় উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাকে।

Advertisement

তেঁতুলিয়া উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবুল বললেন, ‘স্টেডিয়াম উদ্বোধন করা হয়েছে কিছুদিন আগে। তবে এখনো বেশি কাজ বাকি। আমাদের উপজেলার স্টেডিয়ামটি প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের। যে কারণে, বিল্ডিং দুইতলা। বিল্ডিংয়ের ঠিক উল্টো পাশে দুটো গ্যালারি করা হয়েছে। হয়তো শ’পাঁচেক দর্শক গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে পারবে।’

বিল্ডিংয়ে বারান্দা আছে। সামনে আরসিসি বেঞ্চ হবে। তবে কাজ এখনো শেষ হয়নি। বিল্ডিংয়ের নিচতলায় অফিসরুম, ড্রেসিংরুম, টয়লেট আছে। তবে দোতলায় কি কি সুযোগ সুবিধা আছে তা এখনো দেখা হয়নি এই উপজেলা ক্রীড়া সংগঠকের, ‘আসলে স্টেডিয়ামটা আমার বাড়ির পাশে। দোতলায় কি কি হচ্ছে সেটা দেখতে ওপরে উঠি-উঠি করে আর ওঠা হয়নি। তাই ওখানে কয়টা রুম, আর কি কি করা হচ্ছে জানি না’-বলছিলেন মাহমুদুর রহমান ডাবলু।

স্টেডিয়াম তৈরির আগে এখানে আম ও লিচুর বাগান ছিল। গাছগুলো মরে যাওয়ার পর এখানে স্থানীয় ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা করতো। এখন সেই গাছ পরিস্কার করে স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়েছে। ‘মাঠটা এখনো ঠিক খেলার উপযোগী হয়ে উঠেনি। পানি জমে বৃষ্টিতে। মাটি ফেলতে হবে। আমাদের এখানে বেশি খেলা হয় হ্যান্ডবল। মেয়েদের হ্যান্ডবলের জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়তো আমাদের উপজেলার। এখন মেয়েদের ভলিবল হচ্ছে অনেক। পাশে কাজী সাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। কলেজের মেয়েরাও এখানে খেলে থাকে’-বলছিলেন উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক।

এটা দ্বিতীয় ধাপের মিনি স্টেডিয়ামের একটি। অবকাঠামো প্রথম ধাপের চেয়ে উন্নতমানের। তাই এই স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণেরও ঝক্কি-ঝামেলা বেশি হবে। কিভাবে করবেন? জবাবে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘জানি না সেটা কিভাবে হবে। এখনো পানি-বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ থাকবে কিনা তাও জানি না। কারণ, এখনো এ স্টেডিয়াম আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।’

Advertisement

বিল্ডিং তৈরি করায় মাঠ সংকুচিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা হয়নি। কারণ, এখানকার মাঠ এমনিতেই বড়। উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন আছে। স্টেডিয়ামটা ভালো পজিশনে তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার একপাশে স্টেডিয়াম, আরেক পাশে কলেজ। দেখতে খুবই সুন্দর।’

বিল্ডিংয়ের কাজ ভালো হয়নি, রুম ছোট, পানি জমে থাকে মাঠে

বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার সদর উপজেলায় নির্মিত শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের কাজ ভালো হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘উপজেলা চত্বর ভরাট করে আগেই মাঠ বানানো হয়েছিল। তবে সংস্কার করা হয়নি। যে কারণে, বৃষ্টি হলেই এখানে পানি জমে থাকে।’

এই স্টেডিয়ামের বিল্ডিংয়ের সামনে যে আরসিসি বেঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, তার মধ্যে এখন ১০টির মতো আছে। ‘মাঠের দক্ষিণ দিকে পুকুর সংস্কারের সময় কিছু বেঞ্চ ভেঙ্গে গেছে। এখন ৮-১০টির মতো আছে। এরই মধ্যে আমরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে আবেদন করেছি সংস্কারের জন্য’-বলেছেন মো. রফিকুল ইসলাম।

এখানে সন্ধ্যার পর পরিবেশ ভালো থাকে না। মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘সন্ধ্যার পর এখানে মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। তবে উপজেলা মডেল মসজিদের মুয়াজ্জিন এখানে থাকেন। তাই রাতে গেট বন্ধ করে দেন। যখন খেলাধুলা হয় তখন আবার তিনি অন্য জায়গায় থাকেন। এখানে সৌরবিদ্যুৎ আছে। তবে তেমন আলো হয় না। বলতে গেলে রাতে মাঠ অন্ধকারই থাকে।’

এই স্টেডিয়ামে বেশি খেলা হয় ফুটবল। ফুটবলের গোলপোস্ট আছে। ছেলে ও মেয়েরা খেলে। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবলের খেলা হয়। এছাড়া ব্যাডমিন্টন ও ক্রিকেট খেলাও হয়। পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। স্কুলের বাচ্চারাও এখানে খেলাধুলা করে। পাশে বড় একটি পুকুরও আছে। উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘এ মাঠে সব সময়ই খেলাধুলা হতো। এখন বিল্ডিং হওয়ায় উপকার হয়েছে। বসা যায়। খেলার পর ছেলেমেয়রা হাতমুখ ধুইতে পারে। অফিসরুমে ফ্যান আছে। পানি সরবরাহও থাকে।’

উপযুক্ত জায়গায় হয়নি, বেশিরভাগ ইউনিয়নই দূরে

খুলনা বিভাগের ৫৯ উপজেলার মধ্যে প্রথম ধাপে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়েছিল ১৭ টিতে। এর মধ্যে একটি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলায়। তবে এই স্টেডিয়ামটি উপজেলার উপযুক্ত জায়গায় হয়নি। উপজেলার শেষ সীমানায় নির্মাণ করায় বেশিরভাগ ইউনিয়নই দুরে হয়ে গেছে। তাই উপজেলার সবাই খেলাধুলার এই স্টেডিয়ামকে সমানভাগে ব্যবহার করতে পারছে না।

আশাশুনি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এস এম সেলিম রেজা বলেছেন, ‘স্টেডিয়াম অন্য উপজেলা পাইকগাছার সীমানার কাছে। আগেও এখানে মাঠ ছিল। তবে এখানে যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো ছিল না। পুরোটা পথই পায়ে হেঁটেই যেতে হতো। এখন মেইন রাস্তায় গাড়ি রেখে ৫-১০ মিনিট হেটে স্টেডিয়ামে যাওয়া যায়। ওই পথটুকু ভরাট করা লাগবে।’

এখানে সমস্যা হয়েছে বিল্ডিং করায় মাঠ বেশ ছোট হয়ে গেছে। ‘মাঠের পূর্ব পাশে একটা পুকুর আছে। অন্য পাশে গ্রামের বাড়ি-ঘর। আগে মাঠের মাপ ঠিক ছিল। এখন বিল্ডিং করায় পরিমাণ কমে গেছে। এই বিল্ডিংয়ে একটা অফিসকক্ষ, দুইটা টয়লেট, দুইটা ড্রেসিংরুম করা হয়েছে। ফ্যান, পানির লাইন ও পানির জন্য মটর লাগানো আছে। আরসিসি বেঞ্চও দেওয়া আছে। উপেজলার এক কোনায় স্টেডিয়ামটা হওয়ায় এখানে একটি ইউনিয়নের (দরগাপুর) মানুষই খেলাধুলা করে। আমি মনে করি, স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য উপেজলার উপযুক্ত স্থান বেছে নেওয়া হয়নি। আমাদের উপজেলায় ১১ টা ্ইউনিয়ন। বাকি ১০ টাই দুরে।’

এ মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় ব্যক্তিদের ওপরই নির্ভর করতে হয় উপজেলা ক্রীড়া সংস্থাকে। ‘এই স্টেডিয়ামটা গ্রামের মধ্যে হওয়ায় যারা খেলাধুলা করে তাদের বিল্ডিং বেশি ব্যবহার করতে হয় না। তাই বেশিরভাগে সময় ওটা তালা মারাই থাকে। যখন টুর্নামেন্ট হয় তখন খোলা হয়। ওই সময় স্থানীয় চেয়রম্যানের কাছ থেকে টাকা-পয়সা সহযোগিতা নিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এমনিতে রাতে মাঠ অন্ধকার থাকে। কিছু ছেলে-পেলে বসে রাতে আড্ডা দেয়। তবে অসামাজিক কোনো কাজ হয় না। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে টাকার প্রয়োজন তার একটা বাজেট করে ইউএনও কে দিয়ে দিয়েছি। তিনি লোকাল এমপিকে দিয়েছেন। দেখি কি হয়’-বলছিলেন উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক।

আরআই/আইএইচএস/