স্বাস্থ্য

দেশে উৎপাদিত প্রোবায়োটিকের সম্ভাবনাময় বাজার

☞ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়ছে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার☞ দেশের ফিড মিল ও প্রান্তিক খামারিরা প্রোবায়োটিকের ক্রেতা☞ প্রোবায়োটিক ব্যবহারে বাড়ছে মাছ, মাংস ও দুধের উৎপাদন

Advertisement

প্রাণীর অন্ত্রে উপকারী ও ক্ষতিকর দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো অন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। কারণ এদের মাত্রা অন্ত্রে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোর তুলনায় বেশি হতে হবে। এ ভালো ব্যাকটেরিয়া বাড়ায় প্রোবায়োটিক, যা হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তার পাশাপাশি প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে।

মানুষের খাবার তৈরি এবং মৎস্য ও প্রাণী খাতে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার নতুন নয়। কয়েক বছর ধরেই দুই খাতের ফিড মিলগুলো (খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) খাদ্য উৎপাদনে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করছে, যা এখনো সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। বছরে দেশে প্রোবায়োটিকের বাজার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার।

‘অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর দিক থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের প্রোবায়োটিকের দিকে যেতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশ এখন প্রোবায়োটিকের দিকে ঝুঁকছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন ব্যাপক হারে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করছে।’— অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান

Advertisement

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রোবায়োটিক হলো জীবন্ত মাইক্রো অর্গানিজম, যা বেশি পরিমাণে খেলে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় থাকে। ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। এছাড়া উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো অন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি।

এ প্রোবায়োটিক প্রাণীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থেকে মুক্তি দেয়, দেহের প্রদাহ কমায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। হজমতন্ত্র আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সচল ও জোরদার করে। প্রতিদিন ‘প্রোবায়োটিক’ নিলে তা শরীরের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রোবায়োটিক প্রধানত ব্যাকটেরিয়া, ফানগাস ও ইস্টের বিভিন্ন মিশ্রণে তৈরি হয়। প্রাণীর সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোবায়োটিক দরকার।

মৎস্য ও প্রাণীখাতে প্রোবায়োটিক কেন জরুরি?এখন গবাদি পশু হাঁস-মুরগি-মাছ চাষে রাসায়নিক ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়েছে। এতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিকাশ ঘটছে বেশি, যা আমাদের এসব প্রাণীর শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণু দমন করা যায় না। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা মানবদেহে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এজন্যই রোগ দমনে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার অধিক যৌক্তিক এবং স্থায়িত্বশীল।

Advertisement

এছাড়া প্রোবায়োটিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, হজম, হরমোন ও প্রদাহের জিনগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্ক যুক্ত। যার ব্যবহারে এসব সমস্যা থেকে নিরাময় হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রোবায়োটিক ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশেও দিন দিন প্রোবায়োটিকের চাহিদা বাড়ছে।

আরও পড়ুন☞ স্বাস্থ্যসেবা শুধু শহরে নয়, গ্রামেও পৌঁছে দিতে হবে: মন্ত্রীএবার ৬ মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধস্বাস্থ্যখাতে বিশ্বব্যাংকের আরও সহায়তা চান স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রোবায়োটিকের বাজার ৫ হাজার কোটিরতথ্য বলছে, প্রায় এক দশক আগে থেকেই দেশের বেশকিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আমদানির মাধ্যমে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করছে। পশুখাদ্য শিল্পে ও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে এর পরে। শুধু গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি-মাছের খাবার হিসেবে বছরে এ দেশে প্রোবায়োটিকের চাহিদা রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার।

যা পুরোটা আমদানিনির্ভর। এসকেএফ, স্কয়ার, রেনেটা, একমি, এসিআইয়ের মতো বেশকিছু কোম্পানি এ দেশে মৎস্য ও প্রাণী খাতের জন্য প্রোবায়োটিক জাপান, ভিয়েতনাম, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আনছে। দেশের প্রায় ৩০০ ফিড মিল ও প্রান্তিক খামারিরা প্রোবায়োটিকের ক্রেতা।

‘দেশে তৈরি প্রোবায়োটিকগুলো টেকসই গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি এবং মাছ চাষে চমৎকার ফলাফল দেখিয়েছে।আমদানি করা প্রোবায়োটিকের চেয়ে বেশি কার্যকর। দেশের বিভিন্ন কোম্পানির পাশাপাশি বিদেশি একটি কোম্পানি আমাদের প্রোবায়োটিক নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।’— মাইক্রোবায়োলজিস্ট এ কে এম ফয়জুর রহমান

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর দিক থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের প্রোবায়োটিকের দিকে যেতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশ এখন প্রোবায়োটিকে ঝুঁকছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন ব্যাপক হারে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করছে।

তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশেও আগ্রহ বাড়ছে। যে কারণে এটি বড় সম্ভাবনাময় বাজার। তবে দেশে প্রোবায়োটিক উৎপাদিত হলে খামারিরা কম দামে ব্যবহার করতে পারতো। তেমনি রপ্তানিতে যে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, সেটা সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।

দেশে প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে পজিটিভ বায়োটেকবাংলাদেশি কোম্পানি পজিটিভ বায়োটেক লিমিটেড দেশে প্রোবায়োটিক উৎপাদন শুরু করেছে। তিন বছর আগে কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে, যা এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে রয়েছে। সাভারে কোম্পানিটি প্রথাগত বায়োটেক প্রক্রিয়া এবং পেটেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের জন্য তিনটি প্রোবায়োটিক বাজারজাত করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ও সিনিয়র ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজিস্ট এ কে এম ফয়জুর রহমান পজিটিভ বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্রোবায়োটিকগুলো টেকসই গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি এবং মাছ চাষে চমৎকার ফলাফল দেখিয়েছে। আমদানি করা প্রোবায়োটিকের চেয়ে বেশি কার্যকর। দেশের বিভিন্ন কোম্পানির পাশাপাশি বিদেশি একটি কোম্পানি আমাদের প্রোবায়োটিক নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। আমাদের প্রোবায়োটিক তারা লোকাল মার্কেটে বিক্রি করবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারবো।

তিনি বলেন, মৎস্য ও প্রাণী খাতে ফিডের খরচ মোট উৎপাদনের খরচের ৭০ শতাংশ। ফলে ফিডের খরচ সাশ্রয় হলে তাতে যেমন খামারিরা তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে পারবে, তেমনি ভোক্তারা কম দামে মাছ-মাংস পাবে।

আরও পড়ুন☞ নির্দেশনা না মানলে বেসরকারি হাসপাতালের নিবন্ধন বাতিলবেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনায় সরকারের ১০ নির্দেশনাচিকিৎসায় গাফিলতিতে মৃত্যু হলে কাউকেই ছাড় নয়: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

পজিটিভ বায়োটেকের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ড. নূর হোসেন বলেন, আমাদের উৎপাদিত প্রোবায়োটিকের ফর্মুলেশন বাংলাদেশে অনন্য। এটি আমদানি করা প্রোবায়োটিকের থেকে অনেক বেশি কার্যকর। কারণ আমদানির ক্ষেত্রে অনুজীবগুলো বিদেশ থেকে দীর্ঘসময় পরিবহন, স্থানীয়ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়াজাত না করাসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমশ কার্যক্ষমতা হারায়। এছাড়া বাংলাদেশের জলবায়ু ও পরিবেশের সঙ্গে আমদানি করা প্রোবায়োটিক অনুজীবগুলো ঠিকমতো ও সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না।

‘আমাদের উৎপাদিত প্রোবায়োটিকগুলো শতভাগ প্রাকৃতিক উপাদান ও দেশীয় ফর্মুলেশনে তৈরি। ভিটামিন, খনিজ, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলোর বাড়তি পরিমাণ নিশ্চিত করে। এটি ব্যবহারে গবাদি পশুর দুধ ও মাংসের উৎপাদন বেড়েছে।’— পজিটিভ বায়োটেকের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান

ড. নূর হোসেন বলেন, আমাদের উৎপাদিত প্রোবায়োটিকগুলো শতভাগ প্রাকৃতিক উপাদান ও দেশীয় ফর্মুলেশনে তৈরি। ভিটামিন, খনিজ, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলোর বাড়তি পরিমাণ নিশ্চিত করে। এটি ব্যবহারে গবাদি পশুর দুধ ও মাংসের উৎপাদন বেড়েছে। হাঁস-মুরগিতে বাড়তি মাংস হচ্ছে। স্বাদু পানির মাছের উৎপাদনও বেড়েছে।

পজিটিভ বায়োটেকের এখন মাসে ১৫ টন প্রোবায়োটিক উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে, এটি দেশের বর্তমান চাহিদার তুলনায় মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য মন্ত্রণালয় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করলে বাংলাদেশ অল্প সময় প্রোবায়োটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে বলে মনে করেন এ কে এম ফয়জুর রহমান।

দেশি প্রোবায়োটিক-ই সেরাদেশি প্রোবায়োটিকের কার্যকারিতা আমদানি করা প্রোবায়োটিকের চেয়ে বেশি। এতে উৎপাদন বৃদ্ধির হারও প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।

প্রোবায়োটিকের পরিমাণ, প্রয়োগ মাত্রা এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে ওই গবেষণাটি করা হয়। অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান যার প্রধান ছিলেন। তিন বছরের ওই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন। এরই মধ্যে গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক দশটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণা করে দেখা গেছে, আমদানির চেয়ে দেশি প্রোবায়োটিকের কার্যকারিতা বেশি। কারণ বেশিরভাগ প্রোবায়োটিক অন্য দেশ থেকে আমদানি করা হয় এবং সেগুলো তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রোবায়োটিক। তাই নতুন পরিবেশ তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং এবং স্থানীয় অনুজীবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বেশ কঠিন। তাদের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই স্থানীয় পরিবেশে এবং সুস্থ জীবদেহে প্রাপ্ত স্বাভাবিকভাবে উপকার প্রদানকারী প্রোবায়োটিক যে কোনো বিদেশি প্রোবায়োটিক অপেক্ষা শ্রেয়।

এনএইচ/এমএএইচ/জেআইএম