স্বাস্থ্য

হাসপাতালে অস্বাভাবিক মৃত্যু, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

☞ স্বাস্থ্যসেবা আইন দ্রুত গঠন করা প্রয়োজন☞ স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতায় নিয়ে আসতে হবে☞ সমস্যা সমাধানে সব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

Advertisement

দেশের নামি হাসপাতালগুলোতে ভুল চিকিৎসায় অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন থামছেই না। এসব ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করলেও কোনো সমাধান মিলছে না। নামি হাসপাতালে ছোটখাটো সমস্যায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু অভিভাবক ও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। অভিভাবক ও রোগীর স্বজনদের প্রশ্ন, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর মিছিল আর কত বড় হলে রাষ্ট্রের টনক নড়বে।

সম্প্রতি সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর ও অ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে এক অস্বাভাবিক মৃত্যু দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এরমধ্যে মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে আহনাফ তাহমিদের (১০) মৃত্যু ও এর একদিন আগে সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে অ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে রাহিব রেজা (৩১) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এরও আগে ৭ জানুয়ারি বাড্ডার সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যু হয়।

এসব ঘটনায় অভিযোগ জমা পড়লেও ন্যায়বিচার নিয়ে আস্থার সংকটে ভুক্তভোগী স্বজন ও সাধারণ মানুষ। দেশের স্বাস্থ্যখাত ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

Advertisement

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে স্বাস্থ্যসেবা আইন দ্রুত গঠন করা প্রয়োজন। আর স্বাস্থ্যসেবা দাতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।

‘দায়িত্বে অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। দোষ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’— স্বাস্থ্যমন্ত্রী

চলমান ঘটনাগুলোতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে কথা হলে অধিকাংশ মানুষই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। অনেকেই জানিয়েছেন, অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোথাও চিকিৎসকরা সঠিকভাবে রোগী দেখছেন না। যারা দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো এসব বিষয়কে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন☞ সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু, জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালাঅ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগএবার খতনা করাতে গিয়ে আইডিয়াল শিক্ষার্থীর মৃত্যু

Advertisement

সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আহনাফ তাহমিদের মৃত্যু

মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার ও হাসপাতালে মঙ্গলবার সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে আহনাফ তাহমিদ (১০) মারা যায়। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনায় বাবা ফখরুল আলম বাদী হয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা তিন-চারজনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার দুই চিকিৎসককে জেলগেটে দুদিনের জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দিয়েছে। এ ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন।

সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যু

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পাঁচ বছর বয়সী আয়ানকে খতনা করানোর জন্য তার পরিবার বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর শিশুটির আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি মৃত্যু হয় শিশুটির। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হয়। এরপর আদালতে তদন্ত রিপোর্ট উপস্থাপন করা হলে রিপোর্টটি আইওয়াশ বলে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন আদালত। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি আতাবুল্লাহর বেঞ্চ এ আদেশ দেন। কমিটিকে বিষয়টি অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে যুবকের মৃত্যু

রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে অ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে ৩১ বছর বয়সী রাহিব রেজা নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। স্বজনদের অভিযোগ, হেঁটেই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলো রাহিব। ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই রাহিব রেজাকে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। শারীরিক জটিলতার মধ্যেই অ্যান্ডোসকপি করা হয়। যে কারণে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মারা যাওয়া যুবক রাহিব রেজা লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

‘গণমাধ্যমে যেগুলো আসছে, তা সত্য নয়। বিষয়টি ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। রোগী রাহিব রেজাকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়নি। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। যেটি রোগীর জন্য নিরাপদ ছিল। এছাড়া অ্যান্ডোসকপির আগে সবধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়েছিল।’— ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, গণমাধ্যমে যেগুলো আসছে, সেটি সত্য নয়। বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়নি। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। যেটি রোগীর জন্য নিরাপদ ছিল। অ্যান্ডোসকপি করার আগে সবধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল।

চলমান এসব ঘটনায় মর্মাহত জানিয়ে বিবৃতি দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, দায়িত্বে অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। দোষী প্রমাণিত হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াসহ দায়িত্বে অবহেলার জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন☞ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনায় সরকারের ১০ নির্দেশনাচিকিৎসায় গাফিলতিতে মৃত্যু হলে কাউকেই ছাড় নয়: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরচিকিৎসক বাড়ানোর চেয়ে ভালো চিকিৎসক হওয়ার দিকে জোর দিয়েছি

ল্যাবএইড হাসপাতালে মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেন, ল্যাবএইড হাসপাতালে অ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় বৃহস্পতিবার তদন্ত রিপোর্ট আসবে। এর আগে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পরিদর্শন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, শুধু ছোট কোনো হাসপাতাল নয়, এ রকম অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে ল্যাবএইড কিংবা ইউনাইটেড হাসপাতালকেও ছাড় দেওয়া হবে না। ল্যাবএইড হাসপাতালে গত সোমবার রাতে অ্যান্ডোসকপি করাতে গিয়ে একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা অবগত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের টিম সেখানে পরিদর্শন করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর ল্যাবএইডের ঘটনা গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। আমরা সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। একই সঙ্গে তাদের কাছে আরও তথ্য-উপাত্ত চেয়েছি।

তিনি বলেন, এর আগে ইউনাইটেড হাসপাতালে যে ঘটনা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছি। মামলা চলমান। চিকিৎসা নিতে গিয়ে যদি কোনো রোগীর মৃত্যু হয় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকের কোনো গাফিলতি থাকে চলমান আইনানুযায়ী মামলার মাধ্যমে এর বিচার হবে।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, কোনো চিকিৎসকই চান না রোগী মারা যাক। বিভিন্ন দেশেই এমনটা হয়। তবে, হাসপাতালগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার। তদন্ত হওয়া দরকার।

তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে চিকিৎসকদের নিয়ে সমাজে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, রাষ্ট্র ও রেগুলেটরি বডি কেউ দায় এড়াতে পারে না। এগুলো কেন ঘটছে, চিকিৎসকের ভুল ও অবহেলা ছিল কি না, তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কতটুকু, সেগুলো দেখা দরকার।

‘শুধু ছোট হাসপাতাল নয়, অভিযোগের প্রমাণ পেলে ল্যাবএইড কিংবা ইউনাইটেড হাসপাতালকেও ছাড় দেওয়া হবে না। বর্তমানের ঘটনা গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। হাসপাতালগুলোর কাছে তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।’— স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক

বিদেশের সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা কেমন ঘাটতি জানতে চাইলে যুক্তরাজ্যে কর্মরত ও বিদেশে চিকিৎসাসেবায় থাকা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সংগঠন প্ল্যানেটারি হেলথ একাডেমিয়ার ট্রাস্টি ডা. মো. জাকের উল্ল্যাহ বলেন, দেশের চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের ওপর সাধারণ মানুষ আস্থাহীনতায় ভুগছে। দেখা যায়, একজন রোগী একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আস্থা পাচ্ছে না। এরপর আরকজনকে দেখাচ্ছেন। অনেকে দ্বিতীয়বার দেখিয়েও আস্থা না পেয়ে বিদেশে যান। দেশে অনেক ভালো ভালো চিকিৎসক আছেন। তবে অনেক সমস্যাও আছে।

আরও পড়ুন☞ এবার ৬ মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ‘ওষুধের মান পরীক্ষায় কেনা হয়েছে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি’

রোগীদের আস্থা হারানোর পেছনের সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা বড় বিষয় হচ্ছে সময়। বিভিন্ন দেশে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকরা যখন কথা বলেন তখন তাদের কথা শুনে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রে সময় পাচ্ছেন না। আবার অনেকে ভাবে আমার তো অনেক রোগী কীভাবে সময় দেবো।

আরেকটি বড় সমস্যা অনেকে প্যাথলজিস্টদের কাছ থেকে টাকা পায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য টাকা নেয় (রোগীরা মনে করে অযথা আমাদের নানান টেস্ট দিচ্ছে)। আবার দেখা যাচ্ছে হাসপাতালের বাইরে ফার্মাসি কোম্পানিগুলোর লোকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন, ছবি তোলেন। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে তাদের বলে দেওয়া ওষুধ লিখছেন কি না দেখছেন। এগুলো নীতির অবক্ষয়।

এসব সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন জবাবদিহিতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে জবাবদিহিতা নেই। এটি একটি বড় সমস্যা। সব বিষয় একই সঙ্গে হয়তো সমাধান করা সম্ভব হবে না, তবে ধীরে ধীরে এসব সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সব প্রতিষ্ঠানকে একই সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর সরকারি উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

এএএম/এমএএইচ/এমএস