প্রবাস

প্রযুক্তির যুগে ভালোবাসার ধরনের পরিবর্তন এসেছে

মারিয়া আমার সহধর্মিণী এবং আমার ছেলে-মেয়ে জনাথান ও জেসিকার মা। আমার মা আমার ছেলে-মেয়ের বাংলা নাম কিশোর এবং যমুনা রেখে গেছেন। এছাড়াও এদের আমরা বাবা এবং লিল্লা (ছোট্ট সুনি) বলে ডাকি। আমি আমার মাকে মা বলে ডেকেছি বিধায় জনাথান এবং জেসিকা তাদের মাকে মা বলেই ডাকে। মারিয়া আমাদের সবার প্রিয় নানাভাবে। আমার পরিবার একটি অতি সাধারণ পরিবার হলেও বেশ অসাধারণ। যে কোনো পরিবেশে আমরা অ্যাডজাস্ট করে চলতে পারি এটাই আমাদের অসাধারণ দক্ষতা।

Advertisement

আমার ছেলে-মেয়ে খেলাধুলার সুবাদে গোটা বিশ্ব ভ্রমণে অভ্যস্ত, আমি বাংলাদেশি, মারিয়া স্পেনিশ এবং সুইডিশ সব মিলে আমাদের সাধারণ জীবনযাপনের পেছনে যথেষ্ট কারণ জড়িত রয়েছে। প্রচন্ড শীতের দেশে আমাদের বসবাস, মাঝেমধ্যে পরিবেশ চেঞ্জের কারণে হুট করে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে যাই। কখনও সবাই মিলে কখনও কখনও আমি আর মারিয়া। গেছিলাম স্পেনের ভালেন্সিয়া প্রভিন্সের আলিকান্তে শহরে। স্বল্প সময়ে অল্প কিছু কাজ সেরে দুজনে একদিনের জন্য ট্যুরিস্ট হয়ে নতুন করে একটি শহরকে দেখার সুযোগ তৈরি এবং একটি কোয়ালিটি সময় একে অপরকে দিতে পারা চাট্টিখানিক কথা না।

আমার চল্লিশ বছর দূরপরবাস সময়ের ৩১ বছর মারিয়ার সঙ্গে বসবাস সত্ত্বেও একে অপরকে নতুন করে জানা, চেনা, ভাবা এবং ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা এটাও কিন্তু একটা কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি সহজভাবে করার নাম ভালোবাসা। ফেব্রয়ারি মাস অন্যান্য মাসের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন কারণ এ মাসের প্রথম দিকে আমার জন্ম দিন এবং শেষের দিকে মারিয়ার জন্ম দিন, তারপর ১৪ ফেব্রয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, সব মিলে হৃদয়ে তৈরি হয়েছিল ভালোবাসার ঢেউ। এই পরিপক্ক ভালোবাসার ঢেউ যে ভূমধ্যসাগরের ঢেউকেও হার মানাতে পারে সেটা স্পেন ভ্রমণে না গেলে বুঝতে পারতাম না।

কারণ ভ্রমণে যেমন রয়েছে আনন্দ ঠিক তেমনি রয়েছে বিষাদ। যেমন গোলাপ গাছে রয়েছে কাটা, রয়েছে ফুল। মারিয়া আমার ৩১ বছরের জীবনসঙ্গিনী, আমি যেমন তার সন্তানের বাবা সেও আমার সন্তানের মা, আমি যেমন তার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু, সেও আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু— যদি সহজ করে বলি তবে ‘উই আর ফ্যামিলি।’

Advertisement

এতক্ষণে অনেকে বিরক্ত হয়ে ভাবতে শুরু করতে পারেন কেন এত প্যাচাল, পরিবার কি আমাদের নেই? এটা নিয়ে এত ঢাকঢোল বাজানোর কী আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ঢাকঢোল বাজানোর অনেক কারণ আছে, তার আগে আসুন কিছু সামাজিক আচরণ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করি। বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে উদ্ভট কিছু ঘটনা চ্যাগাল দিয়ে ওঠে এবং সেটা এত পরিমাণ ভাইরাল হয় যে শেষে অসহ্য পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেমন চলছে ৬৫ বছরের সুগার ড্যাডি এবং এক ১৮ বছর প্লাস তরুণীর রোমাঞ্চ নিয়ে তুমুল কাণ্ড।

প্রতিদিন বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা প্রবাহের বন্যা বয়ে চলেছে। বউ বা স্বামী রয়েছে সত্ত্বেও গোপনে, অবৈধভাবে কম বয়সের পার্টনার কখনও অর্থ, কখনও স্বার্থ, কখনও প্রেম, কখনও ভালোবাসার বিনিময়ে মেলামেশা করে চলছে। সাগরভরা পানি সেটা নিয়ে কথা নেই অথচ চোখের একফোঁটা পানি যখন ঝরে তখন কেন সেটা নিয়ে হইহুল্লোড়? যাইহোক প্রযুক্তির যুগে ভালোবাসার ধরনের পরিবর্তন হয়েছে অনেক। দুই থেকে তিন মিনিটের দৈহিক সম্পর্কের জন্য কেউ এখন পুরো জীবনটাকে বরবাদ দিতে প্রস্তুত না।

সবাই এখন যার যার ধান্দায় ব্যস্ত। বিলাসিতা জীবনের বড় চাওয়া-পাওয়া নতুন প্রজন্মের। নাদুস নুদুস পাত্র দিয়ে কী হবে যদি বিলাসিতা দিতে না পারে? এ ধরনের প্রশ্ন এখন সময়ের দাবি। সুগার ড্যাডিরা একজন কম বয়সের রমণীর জীবনের বাহ্যিক পরিপূর্ণতা দিতে বিন্দুমাত্র কৃপণতা করছে না। একজন তরুণ সমবয়সী তরুণীকে চেহারা ছাড়া কী দিতে পারে? চেহারা ধুয়ে কি তারা পানি খাবে? নতুন ট্রেন্ড বলছে ‘নো মানি নো ফান।’

গতকাল স্পেনের একটি শহর দিয়ে হাঁটতে পথে দেখা হলো আমার এক সুইডিশ বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধু সুইডেন ছেড়ে স্পেনে বিশাল বিলাসিতার জীবন যাপনে মগ্ন। বিয়ে করেছে তার মেয়ের বয়সের এক রমণীকে। বন্ধু রসিকতার ছলে বললো সে তার পুরোনো যৌবন ফিরে পেয়েছে। রসিয়া বন্ধু আছে ভালো স্পেনে। অপ্রিয় সত্য যে বিশ্বের মুসলিম সাম্রাজ্যে বিবাহ প্রথায় বহু বিবাহ এবং পুরুষের চেয়ে কম বয়সী নারী বিবাহ নতুন কিছু না তবে ইদানীং আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ প্রথা চলমান।

Advertisement

আমি আমার বাবা-মাকে দেখেছি সারাজীবন এক সঙ্গে, আমি নিজেও দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কে অভ্যস্ত ও বিশ্বস্ত। এ যুগে প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বলেছেন ‘অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে কই, তাহার মতো তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো! ধরার ধূলিতে যে ফাগুন আসে কই, তাহার মতো তুমি আমার কাছে কভু আসো না তো!’

বাস্তবে এমনটি কিন্তু হুবহু ঘটে। একটা সম্পর্ককে সুন্দর রাখতে সততা, স্বচ্ছতা বজায় রাখা দরকার। এগুলো সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা, বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়। তবে কখনও কখনও কোনো কোনো সত্য সম্পর্কে দুরত্ব তৈরি করে। যেমন, কথায় কথায় প্রাক্তনের বিষয়ে কথা বলা বা তুলনা আপনার বর্তমান সঙ্গীর আত্মবিশ্বাসকে ক্ষুণ্ন করতে পারে। পুরনো সেই স্মৃতিগুলো নিজের কাছেই রাখুন। আপনার রোমান্টিক ইতিহাসের প্রতিটি দিক খুব বেশি প্রকাশের প্রয়োজন নেই।

আগে কী হয়েছিল, সেসব নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। যতক্ষণ না বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ততক্ষণ পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে এসব নিয়ে কথা বলবেন না। মনে রাখবেন, সন্দেহ সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। আপনি যদি অতীতে কোনও কারণে সম্পর্কে ঠকে থাকেন তাহলে সেটাকে শিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করুন। সঙ্গীর চেহারা বা শারীরিক গঠন যাই হোক তা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করবেন না। এ নিয়ে অযৌক্তিক সমালোচনা করাও ঠিক নয়।

ওজন, বয়স, বা ব্যক্তিগত সাজসজ্জার অভ্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে সচেতন থাকুন। সঙ্গীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের সম্পর্কে কখনও নেতিবাচক কথা বলবেন না, সেটা যতই সত্যি হোক না কেন। এতে দুটো মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে পারে। এসব ছাড়াও সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করবেন না। এতে সম্পর্কের জটিলতা বাড়ে। পাশাপাশি নিজের বন্ধুদের ব্যক্তিগত বিষয় সঙ্গীকে জানাবেন না। এতে পরবর্তীতে আপনি সমস্যায় পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে ছুটিতেও সততা, স্বচ্ছতা বজায় রাখুন। তারপরও আমি এতটুকু বলতে চাই সেটা হলো তাড়াহুড়ো করে জীবনের বারোটা না বাজিয়ে বরং যখন যেটা করার কথা সেটা করার মনমানসিকতা গড়ে তুলুন।

ছোটবেলার শখ বড় হয়ে বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য হলে শত চেষ্টা করলেও পূরণ করা সম্ভব নয়, এটা মনে রাখা দরকার। যেমন, কৈশোর বা যৌবনের প্রেম বৃদ্ধকালে করলে, শত চেষ্টা করলেও তৃপ্তিটা কৈশোর বা যৌবনের মতো হবে না। সেক্ষেত্রে সঠিক প্রেমের সময় সঠিক প্রেম করুন। সর্বোপরি নিজেকে জানতে অন্যের কাছে প্রশ্ন না করে নিজেকে বরং নিজেই প্রশ্ন করতে শিখুন, দেখবেন আপনার পরিবেশ সৃজনশীল হবে। কারণ বই পড়ে কেউ কি ফুটবল খেলা শিখতে পারে? না। তাছাড়া পুঁথিগত শিক্ষা, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য গঠন বা গ্রেড অর্জন করা আর একটি চরিত্র গঠন করা কিন্তু এক নয়।

সংযম, সাহস, সৌজন্য, ন্যায্যতা, বন্ধুত্ব, উদারতা, ভদ্রতা, নম্রতা, দয়া, বাধ্যতা, শৃঙ্খলা, ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ, এর সব কিছু মিলে কিন্তু পরিবারের ভালোবাসা। তবে এর প্রকাশ কিন্তু ঘটে আপনার নিজের মধ্যে। যাইহোক আমার সহধর্মিণী মারিয়া আমার কথা শুনে এখনও হাসে, এখনও কাছে আসে। যার ফলে আমরা দুজনে দুজনারই আজও, তাই সময় পেলে হুট করে যেখানে মন চাই সেখানে চলে যাই। ভ্রমণে অনেক সময় বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যেমন এবার হঠাৎ উট পাখির ডিম চোখে পড়লো।

জীবনে কত ডিম দেখেছি তবে এতবড় ডিম কখনও দেখিনি। মানুষের মুখে শুনেছি ঘোড়ার ডিম তবে চোখে দেখিনি। কিন্তু উট পাখির ডিম এই প্রথম দেখলাম। আর এই প্রথম বহু বছর পরে আমরা দুজনে (আমি আর আমার স্ত্রী) মিলে ১২০ বছর পার করলাম আমাদের জন্মদিন, এবারের স্পেন ভ্রমণে।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এমএস