পাহাড়ের বুক চিড়ে বেরিয়েছে উঁচু-নিচু পিচঢালা সড়ক। অবিরাম ছুটে চলা পথের বাঁকে বাঁকে আদিবাসীদের বসত-ঘর। পাহাড়ের টিলা থেকে হাতছানি দেয় সবুজের অভয়ারণ্য। এই পথের চূড়ান্ত গন্তব্য সাজেক ভ্যালি। সেখানে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
Advertisement
পাহাড়, মেঘ ও নীল আকাশের মেলবন্ধনে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে অনিন্দ্য সুন্দর। এমন দৃশ্য ভ্রমণপিয়াসুদের চোখে প্রশান্তি এনে দিতে যথেষ্ট। সুনসান নীরবতার সঙ্গে বইতে থাকা বসন্তের ঝিরিঝিরি হিমেল হাওয়া নিমিশেই দূর করতে পারে নগরজীবনের একরাশ ক্লান্তি।
গত কয়েক বছর ধরে দেশের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘মেঘের রাজ্য’ খ্যাত এই সাজেক ভ্যালি। যা খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ৬৮ কিলোমিটার দূরে দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। একদল যুবক-তরুণের যাত্রা সেদিকেই।
বন্ধুর পথের দুই পাশে তাদের স্বাগত জানায় পাহাড়ি কোমলমতি শিশুরা। ৬০ জনের বহরে থাকা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষগুলো সামাজিক সংগঠন শিখা সংসদের স্বেচ্ছাসেবী সদস্য। অন্য সব পর্যটকের মতো তাদের উদ্দেশ্য নিছক ভ্রমণ নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রয়াস চালানো।
Advertisement
সম্প্রতি এখানেই দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি চালিয়েছে শিখা সংসদ। ‘গ্রিন সাজেক ক্লিন সাজেক’ স্লোগানে এগিয়ে চলা এই প্রক্রিয়ার শুরুতে ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের পরিষ্কার-পরিছন্নতা অভিযান। এরপর র্যালি করেন তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় লোকজন, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা।
এ সময় পরিবেশ ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্য রক্ষার্থে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তা মেনে চলার আহ্বান জানায় শিখা সংসদ। দ্বিতীয় দিন সাজেক ভ্যালির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো হয়, জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয় লিফলেট।
সাজেকের কার্যক্রম শেষে পড়ন্ত বিকেলে স্বেচ্ছাসেবীরা পাড়ি জমান খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানেও বিভিন্ন স্থাপনায় সাঁটানো হয়েছে সাইনবোর্ড। লিফলেট তুলে দেওয়া হয় পর্যটকদের হাতে।
স্বেচ্ছাসেবীদের এসব উদ্যম এও অক্লান্ত পরিশ্রম কেবল অনুপ্রেরণাই জোগাতে পারে। তবে পরিবেশের সুরক্ষায় যথেষ্ট নয়। দরকার নিজ নিজ অবস্থান থেকে ব্যক্তি সচেতনতা। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
Advertisement
তাদের প্রতি শিখা সংসদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান সবুজের বার্তা, ‘পর্যটন কেন্দ্র বাঁচাতে আমাদের যথাযথ সর্তকতা অবলম্বনসহ সচেতনতার বিকল্প নেই। সেই সচেতনতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবর্ধনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।’
‘সাজেকের মতো দেশে এ রকম আরও দর্শনীয় স্থান আছে। এসব জায়গায় পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করছি দেশজুড়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলাতে আমাদের জনসচেতনামূলক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
শারীরিক ও মানসিক ধঁকল কাটিয়ে উঠতে ১১ জনের পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে পার্বত্য অঞ্চলে এসেছেন সুপ্তি আক্তার। উপভোগ করেছেন সাজেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পরিবেশের সুরক্ষায় ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনার বিকল্প দেখছেন না তিনিও।
আরও পড়ুন
সিকিমের চুংথাং ভ্রমণে যা যা দেখবেন সুইজারল্যান্ডের মতোই সুন্দর ভারতের খাজ্জিয়ার, কীভাবে যাবেন?সংবাদমাধ্যমকে এই পর্যটক বলেছেন, ‘মুক্ত হাওয়া, মুক্ত মনের জন্য পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি। ভালো লেগেছে, উপভোগ করছি। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। আমাদের মধ্যেও সচেতনতা আনতে হবে। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা ঠিক নয়।’
‘শিখা সংসদের কাজ অনুপ্রেরণার। সচেতনতা বাড়াবে। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। আগের চেয়ে (সাজেক) অনেক উন্নত হয়েছে। আমরা চাই এটা বজায় থাকুক। এক্ষেত্রে পর্যটক ও স্থানীয়রা তো আছেনই, (ট্যুর) গাইডদের দায়িত্বশীল হতে হবে। যাতে তারা পর্যটকদের সচেতন করতে পারেন।’
পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলের পথঘাট আরও মসৃণ করতে চলছে রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ। কাটা হচ্ছে একের পর এক ছোট-বড় পাহাড়। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্বেচ্ছাসেবীদের অনুরোধ- যতটা সম্ভব পাহাড় ও টিলার কম বিনাশ করা। অন্তত পরিবেশের ভারসাম্য যেন স্থিতিশীল থাকে।
পরিবেশ বাঁচাতে এর আগে আরও কার্যক্রম চালিয়েছে শিখা সংসদ। এর মধ্যে অন্যতম বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। প্রতিবছর নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানে চারা গাছ রোপণ করে আসছে তারা। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্য জেলাগুলোতে এটি বিস্তৃত করার পরিকল্পনা তাদের। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাজারগুলোতে পরিষ্কার-পরিচন্নতা কার্যক্রম অব্যাহত আছে স্বেচ্ছাসেবীদের।
তবে কেবল পরিবেশ সুরক্ষার লড়াইয়ে নিজেদের সীমাবব্ধ রাখছে না শিখা সংসদ। গত কয়েক দশকে নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড করেছে তারা। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন, অস্বচ্ছলদের বিয়েতে আর্থিক সহযোগিতা, আশ্রয়হীনদের বাড়ি-ঘর নির্মাণে সহায়তা, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, কোরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা, ওয়াজ মাহফিল আয়োজন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা সফরসহ দুস্থ রোগীদের জন্য অর্ধশতাধিক ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পেইন করেছে সংগঠনটি।
১৯৮৩ সালের অক্টোবরে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে প্রতিষ্ঠা হয় সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন শিখা সংসদ। ‘সুন্দর সমাজ গঠনে আমরা অঙ্গীকারবব্ধ’ স্লোগানে ২৮ জন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে শুরু হয় তাদের যাত্রা। ২০২০ সালে নিবন্ধন পওয়া সংগঠনটিতে বর্তমানে কাজ করছেন সাড়ে ৩০০ এরও বেশি সদস্য।
তাদের লক্ষ্য গোটা বাংলাদেশে মানবিক সহায়টা পৌঁছে দেওয়া। এ প্রসঙ্গে সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘শিখা সংসদ দেশজুড়ে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চায়। জনসচেতনতামূলক কাজের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সকল সেবামূলক উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবকীয় কার্যক্রমই আমাদের লক্ষ্য।’
জেএমএস/এমএস