গোধূলিকমল শব্দটার মধ্যে কেমন অন্যরকম এক মাধুর্য। কমল মানে পদ্ম। গোধূলি মানে সন্ধ্যালগ্ন। দুটি শব্দ যুক্ত হয়ে কী অর্থ দাঁড়ায়? সন্ধ্যাপদ্ম! এরকম? শব্দবন্ধটি দেখেই বোঝা যায় এটি সৃষ্টি করেছেন কোনো কবি। এখন সুন্দর প্রচ্ছদপটে শব্দবন্ধটি যদি আপনি কোনো বইতে ছাপা দেখেন, প্রথম দেখায় কী মনে হবে? আপনি হয়তো বইটি দেখে কৌতূহলবশত হাতে নেবেন, পৃষ্ঠা উল্টালেই দেখবেন ভেতরে একটি সূচিপত্র। আশ্চর্য হয়ে দেখবেন সেখানে লেখা উপন্যাসক্রম। আপনি বুঝে যাবেন গোধূলিকমল আসলে একটা উপন্যাসের সংকলন। মোট ৫টি উপন্যাস সংকলিত হয়েছে এখানে: মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ, জ্যোৎস্নার ফুল ফোটার শব্দ, জোৎস্নাবাসর, মেঘের বসন্তদিন, একাত্তরের ভোর।
Advertisement
গোধূলিকমলের রচয়িতা আবু জাফর খান। আবু জাফর খান কবি, ঔপন্যাসিক, সংগঠক। পেশায় চিকিৎসক। বর্তমানে তিনি পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত। তার জন্ম পাবনার সুজানগর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। ঢাকা থেকে কমিউনিটি মেডিসিনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এটুকু তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি; কিন্তু একজন প্রতিভাবান কবি ও ঔপন্যাসিকের পরিচয় এত সংক্ষেপে শেষ করা যায় না। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ’। তারপর থেকেই তার খ্যাতির অগ্রযাত্রা শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের নিয়ে রচিত উপন্যাসটি খুব দ্রুত পাঠকের দৃষ্টি-আকর্ষণ করে। পাহাড়-অরণ্যের কাব্যময় বর্ণনার সঙ্গে তথ্যবহুল উপস্থাপন উপন্যাসটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। একটু উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যাবে, ‘এখানে ত্রিশটি পল্লীতে পাহাড়ি মানুষগুলো কখনো রুদ্র প্রকৃতির তাণ্ডব সয়ে, কখনো রোগ-শোক, জরা-ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোমতে বেঁচে আছে। তবু পাহাড়, অরণ্য, বন-জঙ্গলের সঙ্গে এদের চিরকালের মমতা জড়ানো মায়ার বাঁধন।’ (পৃষ্ঠা-২৩)
আবার তথ্য ও ইতিহাসের দিক দিয়েও উপন্যাসটি সমৃদ্ধ। বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকার নাম বলীপাড়া। এই বলীপাড়া ঘিরেই উপন্যাসের বিস্তার। চাকমা, মারমা, মুরং এই তিনটি উপজাতি সম্প্রদায় বলীপাড়ায় বাস করে। লেখক তাদের কাছ থেকে দেখেছেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি বান্দরবানে নিয়োজিত ছিলেন ২০০৯-১০ সালে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন। ‘মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ’ উপন্যাসের নায়ক শাওন পেশায় একজন চিকিৎসক। বহিরাগত বাঙালি যুবক ডা. শাওন বলীপাড়া গিয়ে যা যা দেখেছেন; তা-ই এই উপন্যাসে তুলে এনেছেন ডা. কে এম আবু জাফর। ডা. কে এম আবু জাফর লেখক আবু জাফর খানের পেশাদারী নাম।
Advertisement
বাস্তবতার সঙ্গে লেখক এ উপন্যাসে কল্পনারও মিশ্রণ ঘটিয়েছেন অঢেল। প্রকৃতির সঙ্গে এখানে মিশে আছে প্রেম, ইতিহাসের সঙ্গে রহস্য। লেখক হিসেবে আবু জাফর খানের আত্মপ্রকাশ একটু দেরিতে হলেও অল্পদিনেই তার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। গত ১২ বছরে তার বই প্রকাশিত হয়েছে ২১টি। প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উপন্যাস ৯টি, কাব্যগ্রন্থ ৯টি, গল্পগ্রন্থ ২টি। দুই বাংলার কবিদের সঙ্গে যৌথভাবে ৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুন• রিফাত হাসানের ‘এখনো ঘোড়ার চাল বাকি’ • বইমেলায় চবি শিক্ষক শাহ্ আলমের ‘আত্মবিশ্বাসের উপকরণ’ • বইমেলায় মোহাম্মদ সলিমুল্লাহর ‘মাস্টার অব ফরেন এক্সচেঞ্জ’
তিনি কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কারও পেয়েছেন: বাংলাদেশ কবিতা সংসদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক, রবীন্দ্র স্মারক সম্মাননা, আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে কথাসাহিত্যে (বাংলাদেশ) বাংলা সাহিত্য পদক, কলকাতা থেকে ড. বি আর আম্বেদকর সাহিত্য সম্মাননা, কলকাতা থেকে প্রকাশিত চোখ পত্রিকার পক্ষ থেকে চোখ সাহিত্য পদক, কবি জসীম উদদীন পরিষদ কর্তৃক পল্লীকবি জসীম উদদীন স্বর্ণপদক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে নজরুল সাহিত্য স্মৃতি স্বর্ণপদক, মাইকেল মধুসূদন একাডেমি, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে মাইকেল মধুসূদন স্মৃতি সম্মাননা ইত্যাদি।
তার উপন্যাস নিয়ে বলতে গিয়ে দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘আবু জাফর খানের উপন্যাসের শিল্পরূপ মনোজগতের বর্ণাভ বিন্যাস।’ কবি নির্মলেন্দু গুণও এক মন্তব্যে বলেন, ‘আবু জাফর খান পেশায় ডাক্তার হলেও নেশায় কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি জনপ্রিয় না হলেও তিনি শিল্পপ্রিয়।’
Advertisement
লেখক আবু জাফর খান নামে যতটা পরিচিত; ব্যক্তি হিসেবে সাহিত্যমহলে ততটা পরিচিত নন। এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে কবি গিরীশ গৈরিক বলেন, ‘তিনি একজন নিভৃতচারী মানুষ। নিজের চিকিৎসা পেশা আর লেখালেখির নেশা নিয়েই তিনি ডুবে থাকেন।’
ঠিক একই কথা বললেন ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক আদিত্য অন্তর, ‘যারা নিভৃতে থেকে লেখালেখি করেন, সাহিত্যচর্চা করেন আবু জাফর খান তাদেরই একজন। তাকে হয়তো এমনিতে লোকে কম চিনে; কিন্তু তার লেখার ধার, বলার ভঙ্গি, চরিত্রচয়ন সব মিলিয়ে তিনি বড়মাপের কবি ও কথাসাহিত্যিক। ওনাকে যদি ঠিকমতো লালন করা যায়, পরিচর্যা করা যায়, একজন প্রকাশক হিসেবে বলতে পারি ওনার কাছ থেকে অনেক বড় কিছু আশা করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘মেলাতেই আমরা তার কোনো কোনো বইয়ের ১ হাজার, বারোশ কপি বিক্রি করেছি। এ বছর ওনার পাঁচটি উপন্যাস নিয়ে গোধূলিকমল প্রকাশ করার কারণ হচ্ছে, একজন পাঠক এক মলাটে পাঁচটি উপন্যাস পাবেন। এখানে রোমান্টিক, সামাজিক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস আছে। একজন লেখক কোন বিষয়ে কীভাবে চিন্তা করেন, কীভাবে চরিত্র নির্মাণ করেন; এই গোধূলিকমল পড়লেই একজন পাঠক আবু জাফর খান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পাবেন। একজন ভালো লেখককে মূল্যায়ন করার যতটুকু দরকার আমরা সেই চেষ্টাটাই করেছি।’
এসইউ/জিকেএস