বিশ্বে যেসব দেশে মেয়েশিশুর বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৩৯ শতাংশ মেয়েশিশুর বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, ৭৪ শতাংশের বিয়ে হয় ১৮ হওয়ার আগেই।গত তিন দশকে দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জেন্ডার সমতা অর্জনের দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; বর্তমানে মেয়ে এবং ছেলেদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশের হার প্রায় সমান এবং সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা নিয়ে গ্রামীণ নারীদের আয়-রোজগারের সুযোগ বিস্তৃত হয়েছে। এই একই সময়ে মেয়েশিশুদের বিয়ের হার ১৪ শতাংশ কমলেও ১৬ এবং ১৭ বছর বয়সীদের বিয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে একটি উন্নয়নশীল দেশে নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে আলোচনার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ও বাল্যবিবাহ আইন পরস্পরবিরোধী। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিয়ে গ্লোবাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ওপেনডেমোক্র্যাসি-তে সেন্টার ফর পোভার্টি অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের উপ-পরিচালক ও ইউনিভার্সিটি অব মালয়ের অর্থনীতি ও প্রশাসন অনুষদের শিক্ষক এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটে অব কেন্টের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক জাকি ওয়াহ্হাজ একটি নিবন্ধ লিখেছেন।নিবন্ধে এই দুই লেখক বলেন, ব্রাক বিশ্বিবিদ্যালয়ের একজন সহকর্মীর সঙ্গে গত তিন বছর ধরে আমরা বাল্যবিয়ে (মেয়েদের) নিয়ে গবেষণা করেছি। আমাদের এই প্রকল্পের শুরু থেকে সরাসরি নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি; যাদের বাল্যবিয়ের অভিজ্ঞতা আছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি, এবং ৭ হাজার নারীর জীবন-পছন্দ নিয়ে ব্যাপক আকারে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমাদের কাজ নারীর বাল্যবিয়ের প্রতিকূল পরিণতিগুলো নিয়ে নতুন প্রমাণ তৈরি করেছে। গ্রামীণ বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের একটি সমাজে কীভাবে বাল্যবিবাহ আইন পরিবর্তন হয় তা উঠে এসেছে।বাংলাদেশে ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ এবং মেয়েদের ১৮ বছর করা হয়েছে। তবে এই আইন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় এবং খুব কম সময় এর প্রয়োগ দেখা যায়। তবে সম্প্রতি এই আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে বাল্যবিবাহের শাস্তি হিসেবে আর্থিক জরিমানাসহ দুই মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই একই সময়ে ২১ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ওই খসড়ায়। এটাকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য করা হবে না।সম্প্রতি নারী ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাখ্যা করেছেন যে গোপনে পালিয়ে যাওয়া ও অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ নিয়ন্ত্রণ করতে খসড়া বিলের বিশেষ বিধান সহায়ক হবে। এই আইন বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যার কাল্পনিক অথবা বাস্তবিক সমস্যার সমাধানে সাংসদদের সর্বশেষ প্রচেষ্টার ফল। এর আগে, ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৮ থেকে ১৬ করার প্রস্তাবের পর স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ব্যাপক প্রতিবাদ দেখায়।মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যদি বর্তমান আইনের অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে এটি জোর করে ১৪ বছর বয়সী তরুণীদেরকে বাবা-মা বিয়ে দেবেন। এছাড়া ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে না দিতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে আন্দোলন চলছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও জাকি ওয়াহ্হাজ বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বিদ্যমান আইন সংশোধনের পুনঃপ্রচেষ্টা ও সৃষ্ট অাইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের অনুশীলন সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রকৃত উদ্বেগ তৈরি করবে।২০১৪ সালের জুলাইয়ে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে `বাল্যবিবাহ রোধ আইন-১৯২৯` সংশোধন ও ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের মেয়েদের বিয়ে নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছে এবং এটাকে আইনে পরিণত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ রয়েছে।এ দুই লেখক আরো বলেন, একই সময়ে, একজন এমপি গত বছর ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাল্যবিবাহ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়ামে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কম বয়সী মেয়েদের গোপনে পালিয়ে যাওয়া ও বিবাহ বহির্ভূত অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ঠেকাতে গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকদের চাপের কারণে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে নামিয়ে আনতে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে বাধ্য হয় সরকার।এই পরস্পরবিরোধী চাপের একটি সুসঙ্গত প্রতিক্রিয়া আছে, এসব দাবি চিহ্নিত করে পিতামাতার উদ্বেগের মূল কারণের ওপর নজর দেওয়া জরুরি। ঐতিহ্যবাহী পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সুদৃঢ় রয়েছে। এছাড়া ছেলে এবং মেয়ের বিশুদ্ধতা পরিবারের সম্মানের সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি সামাজিক বাস্তবতা, যেখানে একজন অবিবাহিত কিশোরীর খ্যাতি সাবধানে রক্ষা করা প্রয়োজন হয়, কারণ তার জীবনের পছন্দ অত্যন্ত সীমিত। দরিদ্র গ্রামীণ পিতামাতার জন্য, বাল্যবিবাহ একটি স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ। কেননা তারা মনে করেন, এটি করা না হলে তাদের সামাজিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।গ্রামাঞ্চলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ ও শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পিতামাতার উদ্বেগ কমবে। তবে সেখানে তারা পুরুষদের দ্বারা যৌন সম্পর্কের জন্য চাপ ও গোপনে পালিয়ে যেতে রাজী হতে পারে। এক্ষেত্রে পুরুষরা বেশি সুবিধা নিতে পারেন। কিন্তু এই হুমকি কতটা বাস্তব? ওই দুই গবেষক বলেন, ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী সাড়ে ৭ হাজার বিবাহিত নারীকে নিয়ে দেশব্যাপি আমরা গবেষণা করেছি, এদের মধ্যে ৮৩ ভাগ নারী বলছেন, তারা পরিবার অথবা স্বজনদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করেছেন, তবে এ ধরনের বিয়ের পেছনে প্রধান কারণ কী? এদের মধ্যে ৭২ ভাগ নারী বলছে, এ ধরনের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করাকেই বাবা-মা বেশি ভালো মনে করেন। এছাড়া গবেষণায় অংশ নেওয়া মাত্র ১৪ শতাংশ নারী পিতা-মাতার আয়োজনে কিংবা পছন্দ ছাড়া বিয়ে করেছেন।গবেষকরা বলছেন, বাল্যবিবাহ আইন সংস্কার করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও মানবাধিকার কর্মীদের সন্তুষ্ট করা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।কিশোরীদের মর্যাদা রক্ষা করতে সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন জরুরী। ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে, যখন স্কুলে ব্যাপক লিঙ্গ ব্যবধান ছিল, সে সময় সরকার একটি কার্যকরী ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মেয়েদেরকে স্কুলমুখী করেছিল। এছাড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যয় কমিয়ে ও স্কুলে নারী শিক্ষকের পরিমাণ বৃদ্ধি এতে ব্যাপক অবদান রেখেছে।একই ধরনের এক লাইনের একটি ক্যাম্পেইন যদি বাল্যবিাহের বিরুদ্ধে তুলে ধরতে বর্তমান সরকার সক্ষম হয়, তাহলে অভিভাকদের যে চাপ সরকার মোকাবেলা করছে তা স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। কিশোরীদের জন্য এ ধরনের সংগঠন করা যেতে পারে, যারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে দিক নির্দেশনা দেবে। আইন সংস্কারের চেয়ে এটি বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।এসআইএস/বিএ
Advertisement