প্রত্যেক মানুষের একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে। আরেকটা জীবন থাকে তাঁর কর্মের, যে জীবনটা মূলত পাবলিক। যখনই আমরা আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলি, তখন জীবনটি একান্তই আপনার। সেখানে অন্য কারোর অনুপ্রবেশ নাই। সেখানে আপনার আনন্দ, আপনার হাসি কান্না, আপনার সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা- এটা একান্তই আপনার, যেটা অন্য কেউ দেখছে না, অন্য কেউ প্রভাবিত করতে পারছে না। যেটার প্রভাবক মূলত আপনি নিজে। আপনার ব্যক্তিগত জীবনের যে ঘটনা, ছোট ছোট যে সব ইভেন্ট সেটা শুধু আপনি জানবেন বা আপনার পরিবারের লোকজন জানবে। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। কিন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা যেটা করছি, সেটা হচ্ছে আমরা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। প্রাইভেসি বলে যেন এখন কিছুই নেই। আমরা কোথায় যাচ্ছি, কার সাথে কথা বলছি, কি পড়ছি, কি খাচ্ছি, কি কথা বলছি-প্রত্যেকটা জিনিস আমরা কিন্তু স্ব-ইচ্ছায় সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে সবার দেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর, তাতে যেটা হচ্ছে সেটা হলো- যা আপনার ব্যক্তিগত থাকার কথা ছিল সেটা আপনার আর ব্যক্তিগত থাকছে না। সেটা সারা বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, আলটিমেটলি সেটার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বা নেগেটিভলি এফেক্টেড হচ্ছেন আপনি নিজে এবং আপনার পরিবার। তাই, ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগত রাখাই ভালো।
Advertisement
মূলত, ছয়টি কারণে আপনার ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত রাখাই শ্রেয়।
এক.এক নাম্বার কারণ হচ্ছে, জীবনের প্রাইভেসির অভাব দেখা দিবে। যখনই আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে আপনি উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন, তখন আসলেই তো আপনার প্রাইভেট বলে কিছু থাকছে না। বেশ কিছুদিন আগে, ভারতীয় এক অভিনেত্রী সামান্থা রুথ’কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, বিচ্ছেদের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, কিভাবে তিনি তা সামলেছেন? উত্তরে এই অভিনেত্রী বলেছিলেন যখনই আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু পোস্ট করি তখনই অন্যদের আমাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে উৎসাহিত করি বা আমন্ত্রণ জানাই। তারা আমাদের নিয়ে কথা বলার অধিকার পেয়ে যায়। আর সেখানে ভালো, মন্দ আর কুৎসিত সবই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবন যত কম শেয়ার করবেন তত কম মানুষ সেখানে নাক গলানোর সুযোগ পাবে। আপনার যে বিষয়টি অন্যদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না, অন্যরা সেখানে আগ বাড়িয়ে পরামর্শ বা মন্তব্য না করলেই আপনার জন্য সুবিধাজনক; আর এই জন্যই বুঝি বলা হয় যে গোপনে সুখী জীবন যাপন করুন।
দুই.অন্যের হাসির পাত্র হবেন তখনই যখন আপনি আপনার ব্যক্তিগত বিষয় সবার সামনে শেয়ার করে দিবেন। তখন তার মধ্যে আপনার ভালো বিষয় যেমন থাকবে, খারাপ বিষয়ও থাকবে। আপনাকে নিয়ে হাসি, ঠাট্টা, রং, তামাশা করার অনেক উপাদান আপনি নিজেই সরবরাহ করবেন। আপনি আপনার কাছের কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছে কোনো একটা মুহূর্তের কথা রাগের কথা, মনের দুঃখের কথা, অতীতের কোনো কষ্টের কথা বা অভিযোগ, আপনি সব বলে দিলেন। এরপর আপনি আপনার এই কর্মকাণ্ড নিয়ে আফসোস করবেন।
Advertisement
এই আফসোস করার যে ব্যাপার, এটা কিন্তু সবাই আমরা করি। কথা একটা বলেই সাথে সাথে বলি- কেন বললাম? না বললেই ভালো করতাম। আমরা খুব রাগের মাথায় বা আবেগীয় মুহূর্ত যে নাটক করে ফেলি, সেটা একান্ত হলে ভালো। দর্শক থাকলে সেটা আর আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। অল্প কিছু সময় বাদে আপনি ওই মুহূর্ত থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ঢুকে পড়বেন। কিন্তু, আপনার ওই সময়ের সাক্ষী সে কিন্তু বিষয়টি বয়ে নিয়ে বেড়াবে। মাঝে মাঝে আপনাকেও মনে করিয়ে দিবে। আর, অন্যদের কাছে যখন সেই ব্যাপারটি শেয়ার করবে তখন তাদের কাছে সেটা হয়ে উঠবে মুখরোচক কোনো গল্প। ব্যাঙ্গাত্মক কিছু বললে সেটা কি আপনার ভালো লাগবে? তাই যখন আপনার কোনো নাটকীয় আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করবেন তখন খুব সাবধান।
তিন.অযথা লোকে আপনাকে উপদেশ দিবে। আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কথা বিশেষ করে ভুল বা কোন নেতিবাচক ব্যাপার যত কম লোকের সাথে শেয়ার করবেন, ততই আপনার জন্য মঙ্গলজনক। একইভাবে আপনার ব্যক্তি জীবনে অনেকে এসে উপদেশ দেব, পরামর্শ দিবে,অযাচিত সব কথা বলবে। অন্যকে তো আর আপনি থামাতে পারবেন না। আপনি যেটা পারেন সেটা হচ্ছে, আপনি নিজেকে থামাতে পারেন। কিন্তু, নিজেকে যখন আপনি এক্সপোজ করে দিচ্ছেন তখন অন্যরা আপনাকে নিয়ে বারবার বিভিন্ন ধরনের উপদেশের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। আপনি সেগুলো গ্রহণ করবেন, কি করবেন না সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। নিজের জীবনে যত নিজের বোঝাপড়া দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন ততই ভালো। কারণ, আপনার জীবন কিন্তু আপনিই ভালো বোঝেন।
চার.নিরাপত্তার অভাব দেখা দিবে। নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনা করুন, তখনও আপনার ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগত থাকা উচিত। আপনি কোথায় আছেন, কোথায় থাকেন, আপনার ঘরে কি আছে, আপনার বাসায় কি কি ফার্নিচার আছে, আপনার হাত ঘড়িটি দেখতে কেমন, এগুলোর দাম কত, কত কত স্বর্ণালংকার আছে, এগুলো যত কম লোকের সাথে আপনি শেয়ার করবেন ততই নিরাপদে থাকবেন। আপনার সম্পদও নিরাপদে থাকবে। আপনি কত ধনী আর কত সুখে আছেন সেটা লোককে দেখানোর চেয়ে আপনার নিজের নিরাপত্তা আর সুখ আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি দামি।
পাঁচ.নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে। অন্যের মন্তব্য লোকে কি বললো, এই সব বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিবেন যখন তখন আপনি অন্যের মতামতের উপরে মূলত নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। এটাতে কি হবে? আপনার মানসিক শান্তি অন্যের উপর নির্ভর করবে। আর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক। সেটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনি ফোকাস হারাবেন প্রতি মুহূর্তে।
Advertisement
ছয়.ব্যক্তিগত শান্তি ভঙ্গ হবে। আপনি যত বেশি মানুষের সঙ্গে নিজের জীবন ভাগ করে নিবেন, ততই আপনি কাছের মানুষের গভীরতা হারাবেন। বিশ্বস্ত ও আপন মানুষদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তার মানে এই না যে আপনি কাউকে কিচ্ছু বলবেন না। অবশ্যই আপনার কাছেরও বিশ্বস্ত মানুষদের সঙ্গে জীবনের খুঁটিনাটি ভাগ করবেন। বিপদে সাহায্য চাইবেন। প্রয়োজনে পরামর্শ চাইবেন। আপনার আনন্দ দুঃখকে ভাগ করে নিবেন। তবে শুধু শুধু ব্যক্তিগত জীবনের এমন কিছু শেয়ার করবেন না। যাতে নিজের নিরাপত্তা আর শান্তি বিঘ্নিত হয়।বিশেষ করে আপনার আর্থিক বিষয়গুলি, আপনার স্বাস্থ্যের বিষয়গুলি, আপনার একান্ত পারিবারিক ঝামেলার বিষয়গুলি, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কের বিষয়গুলি কারোর সাথে শেয়ার করবেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা যখন কোথাও বসি তখন মূলত আমরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। কোন বিষয়টি শেয়ার করা উচিত আর কোন বিষয়টি শেয়ার করা উচিত না, সেটা ভুলে গিয়ে আমরা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো শেয়ার করি এবং কাছের মানুষ হোক আর দূরের মানুষ হোক পরবর্তীতে আমাদের কথাগুলিরই সুযোগ নেয়। সেইগুলো কথা আমাদের কাছে ফিরে আসে এবং আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। আর এজন্যই বলা হয় যে, আপনার যে ব্যক্তিগত জীবন, যেটা একান্তই আপনার সেটা আপনার হয়ে থাকুক। কথা এমন একটা বিষয় আপনি যখন কাউকে কিছু বলবেন সেটি আর ফেরাতে পারবেন না। ফলে কথা বলার আগে খুব ছিন্তা ভাবনা করে বলুন। কথা কম বলুন, শুনুন বেশি। আমাদের বলতে হবে কম, শুনতে হবে বেশি। সুতরাং, যে কথাই বলুন না কেন হিসাব করে বলতে হবে।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/এএসএম