জাতীয়

ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম: রচিত হয়েছিল একুশের প্রথম কবিতা

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় এ সংগঠন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু’ শিরোনামের ঘোষণাপত্রে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্টভাষা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

Advertisement

ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু করলেও জন্মভূমি চট্টগ্রামেও তিনি ছড়িয়ে দেন সেই আন্দোলন। অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদিত পুস্তিকা ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও বেশ প্রভাব ফেলে। ১৯৪৭ সাল থেকেই তমদ্দুন মজলিসের চট্টগ্রাম শাখার নেতারা বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অধ্যাপক আবুল কাসেমের হাত ধরেই আন্দোলনে যুক্ত হন ভাষা আন্দোলন নিয়ে কালজয়ী কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী।

সেই স্মৃতি স্মরণ করে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান অধ্যক্ষ আবুল কাশেম ছিলেন আমার ছোট মামা এল এ চৌধুরীর বন্ধু। এই সুবাদে তার সঙ্গে আমার ছেলেবেলা থেকেই পরিচয়। ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি আমাকে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন করার জন্য একটি চিঠি দেন। এই চিঠির ভিত্তিতে চট্টগ্রামের তমদ্দুন মজলিসের ফরমানউল্লা খান, মাহফুজুল হক এবং তারেক ইসলামকে নিয়ে আমরা কলেজ হোস্টেলের একটি কামরায় মিলিত হই।’ (বই: জাতীয় মুখশ্রী- মাহবুব উল আলম চৌধুরী)

পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের আহ্বান জানালে চট্টগ্রামেও তা পালিত হয়।

Advertisement

তমদ্দুন মজলিসের নেতাদের মধ্যে সোলায়মান খান, এজাহারুল হক, সাদেক নবী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (মন্টু), চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, মাহফুজুল হক, মো. ইব্রাহীম, শাহ ওবায়দুর রহমান, মকসুদুর রহমান প্রমুখ এ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ এবং জহুর আহমদ চৌধুরীও এসব আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে দ্বিধা করেননি।

১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে ইশতেহার প্রচার করেন তমদ্দুন মজলিস কর্মীরা। এ অপরাধে চট্টগ্রাম কলেজের তমদ্দুন মজলিস কর্মী মোহাম্মদ এজাহারুল হক ও ফরমান উল্লাহ খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। খবর পেয়ে তাদেরকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন জহুর আহমদ চৌধুরী।

সেই ঘটনা স্মরণ করে ভাষা সৈনিক এজাহারুল হক লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবস। ...স্থির করলাম যে স্বাধীনতা দিবসে দেশের সমস্যার ওপর তমদ্দুন মজলিসের পর্যালোচনা ভিত্তিক একটা বক্তব্য থাকা উচিত। আমরা তিনজনে মিলেই ইশতেহার লিখলাম। ১৪ আগস্ট পলোগ্রাউন্ডের মিটিংয়ে তা বিলি করার সময় পুলিশ আমাকে ও ফরমান ভাইকে গ্রেফতার করে। ....সারাদিন আমাদের অনেক কষ্ট হলো। খবর পেয়েও কোতোয়ালি থানায় কেউ আমাদের দেখতে আসেনি। সন্ধ্যার দিকে জহুর আহমদ চৌধুরী খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে কোতোয়ালি থানায় এসে নিজেই জামিন হয়ে আমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান।’

আরও পড়ুন• দেশের গণ্ডিতেই আটকা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটহাইকোর্টের নির্দেশনার ১০ বছর, বাস্তবায়নের চেষ্টা নিয়ে প্রশ্নকালজয়ী বইয়ের মোড়কে সাজানো দৃষ্টিনন্দন বই-দেওয়াল

Advertisement

১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন যখন শহরে বাধা পাচ্ছিল, তখন তা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের ১১ মার্চ চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়া কলেজ ও স্কুল, ধলঘাট, কেলিশহর, সারোয়াতলী, কাটিরহাট, নানুপুর, নোয়াপাড়া, আর্যমিত্র, কোয়েপাড়া, মহামুনি, রাধারানী প্রভৃতি স্কুলের হাজার হাজার ছাত্র বাংলাকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট পালন করেন।

১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশমালায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার দাবি উপেক্ষিত হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে চট্টগ্রামের মানুষ। এ দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে শেখ রফিক উদ্দিন সিদ্দিকীকে সভাপতি ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে যুগ্ম সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠিত হয়।

১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিস যাত্রা শুরুর পর সংগঠনটির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হতো ‘সৈনিক’ পত্রিকা। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও তমদ্দুন মজলিসের কর্মী আবুল কালাম আজাদ পত্রিকা প্রকাশের জন্য জাদু প্রদর্শনীর মাধ্যমে তহবিল গঠন করেছিলেন। ওই টাকা তিনি তুলে দেন তমদ্দুন মজলিস সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেমের হাতে। তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক বইটি ছিল চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠার অন্যতম রূপকার।

একই বছরের নভেম্বর মাসে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘সীমান্ত’ নামে মাসিক প্রতিবাদী সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনা শুরু হয়। তখন এই ভাষাসংগ্রামীর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ভাষা আন্দোলনে এই পত্রিকা রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৪৮ সালে ‘সীমান্ত’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম ‘সংস্কৃতি বৈঠক’ গঠিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সীমান্তের ৪৮টি সংখ্যা বের হয়।

১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী শহীদুল্লাহ সাবের (শহীদ সাবের)। কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সাবেরের সঙ্গে পরিচয় হয় তৎকালীন তরুণ কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে মুসলিম লীগের লোকজনের আক্রমণের শিকার হন প্রগতিশীল আন্দোলনের এই কর্মীরা।

পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের আহ্বান জানালে চট্টগ্রামেও তা পালিত হয়। প্রতিবাদ সভার প্রচারের জন্য ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে মাইকে প্রচারের সময় মুসলিম লীগের কিছু লোক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, শহীদ সাবের ও গোপাল বিশ্বাসের ওপর হামলা করে। সেদিন হামলাকারীরা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভাও পণ্ড করে দেয়।

ওই ঘটনা স্মরণ করে ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালে ১১ মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবস ঘোষণার পর এ উপলক্ষে চট্টগ্রামে জে এম সেন হলে অনুষ্ঠিতব্য জনসভার প্রচারণা করি আমরা। আমি আর শহীদ সাবের মাইক নিয়ে প্রচারে নেমেছিলাম। লালদীঘিতে মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করে মাইক কেড়ে নিয়ে যায়। আমরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করি।’

এদিন থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় ছাত্রধর্মঘট, ক্লাস বর্জন ও বিক্ষোভ মিছিল। চলে ১৪ মার্চ পর্যন্ত। ১৪ মার্চ চট্টগ্রামের প্রশাসন এক সপ্তাহের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।

১১ মার্চের চট্টগ্রামের সেই আন্দোলনের খবর উল্লেখ করে ১৯ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কানুনগোপাড়া কলেজ ও স্কুল, ধলঘাট, সারোয়ারতলী, কাটিরহাট, নানুপুর, কুইরাইল, নোয়াপাড়া, আর্যমিত্র, কোয়েপাড়া, মহামুনি, রাহাকানী কেলী শহর প্রভৃতি বিভিন্ন স্কুলে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান- বৌদ্ধ ছাত্র বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট করে। তারা সভা শোভাযাত্রা করিয়া পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষার দাবিকে অস্বীকার করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।’

১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর পকিস্তানের শিক্ষা ও বাণিজ্যমন্ত্রী ফজলুর রহমান চট্টগ্রাম কলেজ পরিদর্শনে আসলে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে তাকে একটি খোলা চিঠি (ইশতেহার) দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ওই ইশতেহার বিলির অপরাধে ফরমান উল্লাহ খান ও শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাককে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী।

এরপরও অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চট্টগ্রাম কলেজে ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করেন তমুদ্দুন মজলিসের কর্মীরা। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস কর্মীরা ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিতে জাদু প্রদর্শনী, কবিগান, মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালার আয়োজন করেন।

১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশমালায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার দাবি উপেক্ষিত হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে চট্টগ্রামের মানুষ। এ দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে শেখ রফিক উদ্দিন সিদ্দিকীকে সভাপতি ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে যুগ্ম সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির উদ্যোগে লালদীঘিতে জনসভা হয়। সভা শেষ জনতা একটি মিছিল নিয়ে চট্টগ্রামের দুই গণপরিষদ সদস্য এ কে খান ও নুর আহমদ চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করেন। এসময় ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারলে তারা পদত্যাগ করবেন’- এমন অঙ্গীকার নেওয়া হয়।

১৯৫১ সালের মার্চে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ ও সাংস্কৃতিক বৈঠকের উদ্যোগে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সভাপতিত্বে চট্টগ্রামে আয়োজিত হয়েছিল ‘সাহিত্য- সংস্কৃতি’ সম্মেলন। সম্মেলন সফল করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান ও সাইদুল হাসান।

সম্মেলন উদ্বোধন করেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সত্যযুগ পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। সম্মেলনে কলকাতা থেকে একদল সংস্কৃতিকর্মী নিয়ে যোগ দেন সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস ও সুচিত্রা মিত্র।

লেখক ও গবেষক শরীফ শমশির তার রচিত ‘চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৫১ সালের ১৬ থেকে ১৯ মার্চ হরিখোলার মাঠে (বর্তমান হিন্দু ফাউন্ডেশন ভবন এলাকা) অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সভাপতি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন।’

আরও পড়ুন• নিশ্চিত হয়নি বাংলায় সাইনবোর্ড-নামফলক ব্যবহার, নেই তদারকিকিছু লোক টাকা হলেই মনে করে ইংরেজিতে কথা বললেই স্মার্টশিক্ষাজীবনে কাজে আসে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন ঘোষণা দেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার ওই ঘোষণার প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। ওইদিনই গঠন করা হয় চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ। আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক সংগঠনের আন্দরকিল্লার অফিস তখন ব্যবহার হতো ভাষা সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর হিসেবে। ওই অফিস থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ, তমদ্দুন মজলিস ও বাম নেতাকর্মীরা ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করেন।

সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নেতা ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। এছাড়াও অন্যদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন- জহুর আহমদ চৌধুরী (আওয়ামী মুসলিম লীগ), মোজাফফর আহমদ (আওয়ামী মুসলিম লীগ), ডা. আনোয়ার হোসেন (শিল্পপতি), আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ), চৌধুরী হারুন-আর-রশিদ (তমদ্দুন মজলিস নেতা), হাবিব উল্লা (তমদ্দুন মজলিস/পরে সাংবাদিক), নুরুজ্জামান, কৃষ্ণগোপাল সেনগুপ্ত (কালা চাঁদ), শামসুদ্দিন আহমদ, মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, ইয়াহিয়াহ খালেদ (তমদ্দুন মজলিস), এমএ মান্নান (তমদ্দুন মজলিস নেতা ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা), এমদাদুল ইসলাম, আবু জাফর, ডা. সাইদুর রহমান, আমির হোসেন দোভাষ (ভাষা আন্দোলনে অর্থ সাহায়তাকারী), এজাহারুল হক প্রমুখ।

আন্দোলনের খরচ জোগাতে দোকানে-দোকানে চাঁদা তোলার বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়। এসময় আবদুল্লাহ আল হারুনকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

একুশের প্রথম কবিতা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল সফল করতে দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয় চট্টগ্রামে। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম এ আজিজের উদ্যোগে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠনের উদ্যোগ চলছে। একুশে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল পালনের জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের কর্মীদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।’

১৯ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সারা রাত নগরীর বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান। ১৯ ফেব্রুয়ারি সারা শহরে বৈঠক ও বক্তৃতা করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। কিন্তু সন্ধ্যায় আন্দরকিল্লায় সংগ্রাম পরিষদের অফিসে একুশে ফেব্রুয়ারির সভা নিয়ে আলোচনার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন।

মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে থাকায় চৌধুরী হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। এদিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ছিল বন্ধ। হরতাল চলাকালে টেলিফোনে ঢাকায় গুলির খবর পান আন্দোলনকারীরা। তখনই বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল নিয়ে পুরোনো ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের দিকে যেতে শুরু করেন। এর মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে রেলওয়ে শ্রমিকদের একটি বিশাল মিছিল বের হয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম কলেজ এবং মেডিকেল কলেজ থেকে পৃথক মিছিল বের হয়। পরে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে লালদীঘি মাঠে যায় এবং সেখানে সমাবেশ করে।

২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অদ্য এখানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ও আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার প্রতিবাদে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সব দোকানপাট, কারখানা, সরকারি অফিস, সিনেমা হল ও স্কুল কলেজে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ছাত্র ও জনসাধারণ শোভাযাত্রা সহকারে লালদীঘি ময়দানে সমবেত হয় এবং মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে সেখানে এক সভা হয়। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। সভায় ৪০ হাজারের অধিক লোক সমাগম হয়। গ্রামের স্কুলের ছাত্ররাও ধর্মঘট পালন করে।’

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল আহ্বান, লালদীঘি ময়দানে সর্বদলীয় জনসভার আহ্বান করা হয়। পরদিন চট্টগ্রামের অফিস-আদালত বন্ধ করে সরকারি কার্যক্রম অচল করে দেয় সংগ্রাম পরিষদ।

খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছান ২২ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ঢাকায় গুলির খবর অসুস্থ মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে জানানো হয়। এর পরই রচনা হয় ইতিহাস, কবি মুখে মুখে রচনা করেন অমর কবিতা – ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।

কোহিনূর প্রেসের স্বত্বাধীকারী আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের (দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা) অনুরোধে প্রেস ম্যানেজার দবির আহদম চৌধুরী এই কবিতা ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। প্রকাশক পুস্তিকাটির পেছনের মলাটে লিখেছিলেন, ‘এই কবিতার লেখক মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক। বাংলাকে রাষ্টভাষা করার দাবিতে যারা চট্টগ্রামে এগিয়ে আসছিলেন তাদের মধ্যে এর অবস্থান সর্বাগ্রে।’

২২ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি মাঠের কাছে ভিক্টোরিয়া পার্কে (বর্তমানে সেখানে পেট্রোল পাম্প) নির্মাণ করা হয় চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার। যদিও রাতে পুলিশ সেটি ভেঙে দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি আবার তৈরি করা হলে দুইদিন পর পুলিশ আবারও ভেঙে দেয়।

পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি মাঠে ৫০ হাজার লোকের সমাবেশে কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুনুর রশিদ। এ দায়ে চৌধুরী হারুনুর রশিদকে গ্রেফতার করা হয়। হুলিয়া জারি হয় কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে, বাড়ির সামনে বসানো হয় পুলিশ পাহারা। মাহবুব উল আলম চৌধুরী রাতের অন্ধকারে বোরকা পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এরপর মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চট্টগ্রামে চলতে থাকে ভাষা আন্দোলনের নানান কর্মসূচি। ১ মার্চ লালদীঘি ময়দানে আরেক সমাবেশ হয়। চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলন কেবল চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রাম পর্যন্ত।

কবিয়াল রমেশ শীল লিখেন একুশের গান- ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি/ ভাই ঢাকা শহর রক্তে রাঙাইলি’। ১৯৫২ সালে কবিয়াল রমেশ শীলের এই গানের জনপ্রিয়তা ছিল কিংবদন্তির মতো।

ঘটনাবহুল ১৯৫২ সালে ভাষা সংগ্রামের ওপর প্রথম নাটক ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’ রচনা করেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান। যা রেডিও পাকিস্তানের কর্মকর্তা সাদেক নবীর পরিচালনায় চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে মঞ্চস্থ করা হয়। এতে অভিনয় করেন চট্টগ্রামের তমদ্দুন মজলিস কর্মীরা। নাটকটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ওপর মঞ্চস্থ হওয়া প্রথম মঞ্চনাটক।

এএজেড/কেএসআর/জেআইএম