‘বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে বলা একটা অপরাধ। আমার বন্ধু সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। ওনার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা। উনি হাসতে হাসতে আমাকে বলেন, রফিক সাহেব আমি তো বাংলিশ বলি না৷ যদি ইংলিশ বলতে হয় ইংলিশ বলি আর না হলে বাংলা বলি। বাংলিশ বলি না। এরকম ব্যাপার তো, কথা হলো যে, আমরা বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মতো কোনো অবস্থানে আর নেই। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, এটা একটা বড় পরিচয় আমাদের। এটাকে যতদিন একটু শ্রীবৃদ্ধি করতে পারি, একটু ভালোভাবে রাখতে পারি, এটা নিয়ে আমাদের চেষ্টা করা উচিত। সেই সঙ্গে আমি মনে করি ইংরেজি ভাষাও আমাদের ভালোভাবে শেখা, আয়ত্ত করা এবং রপ্ত করা দরকার জাগতিক প্রয়োজনে।’
Advertisement
বেশ আক্ষেপ নিয়েই কথাগুলো বলছিলেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক। বয়স প্রায় ৯৫ বছর। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ালেখা করলেও তিনি সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে বহু প্রবন্ধ, বই লিখেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান।
এখন সময় কাটে কীভাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে আহমদ রফিক বলেন, ‘সময় কাটে শুয়ে-বসে, চিন্তা-দুশ্চিন্তা- এসব নিয়েই কোনোভাবে সময় কাটে। যদি কখনো চিন্তা হয় দুই-চার লাইন মাথায় এসেছে লিখতে হবে, দিনের বেলায় এই কালামকে (আবুল কালাম, আহমদ রফিকের দেখাশোনা করেন) ডাকি এইটা একটু নোট করো বা লেভো। সে লিখে আবার আমাকে শোনায়। আমি সংশোধন করে দেই। আবার বলি একটু নোট করে রাখো, পরে দেখে দেবো। আর কিছু গান শোনা, কিছু গান রিমেক করা- এটা আমার নতুন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সেগুলো রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান কিন্তু না, তার গান রিমেক করা প্রায় অসম্ভব।’
আরও পড়ুন• সর্বস্তরে বাংলা: হাইকোর্টের নির্দেশনার ১০ বছর, বাস্তবায়নের চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন• ভাষাসৈনিকদের নামে সড়ক: নামফলক জরাজীর্ণ, পোস্টারে ঢাকা জীবনী
Advertisement
জীবন নিয়ে বেশ আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাঝে মাঝে ভাবী জীবনটাকে যদি অন্যভাবে আমাকে পাল্টানোর সুযোগ দেওয়া হতো। তাহলে আমি আমার পছন্দমতো জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে পারতাম। যেই ভুলগুলো এই জীবনে করেছি, সেই ভুলগুলো করতাম না। মাঝেমধ্যে খুবই দুঃখ হয় যে জীবনটাকে সদার্থে কতটুকুই বা ব্যয় করতে পারলাম, কতটুকু পারলাম না! এই হিসাবটা আমি কোনোদিনই করিনি কিন্তু করা উচিত ছিল।’
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ওই ঘটনা শুধু বইপত্রে লেখা হয়েছে তা নয়। আমি নিজেও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে বইপত্র লিখেছি। সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ভাষা আন্দোলন এমন একটি আন্দোলন যেটি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান। তার সঙ্গে মিলিয়ে সর্বস্তরে বাংলা চাই, জীবনের সব স্তরে বাংলা তাই। এই দাবিটা তখনকার সময়ে কতটা সঠিক ছিল, পরবর্তী সময়ের জন্য কতটা সঠিক ছিল বা এখনকার সময় কতটা সঠিক? এগুলো যদি বিবেচনা করতে যান তাহলে মহা ধাঁধার মধ্যে পড়বেন। কারণ সময়টা তখন যেমন জটিল ছিল এখন জটিলতর বা জটিলতম অবস্থায় আছে। আমি আপনি আমরা কেউই একটা ভালো অবস্থায় আছি সেটি মনে করি না। জীবনযাপনের জন্য যে যেভাবে পেরেছে চেষ্টা করেছে। নাকডুব পানিতে থেকে আবার উপরে উঠে শ্বাস নিয়ে আবার ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা। এটা আমাদের সবার জন্য সত্য।’
এই ভাষাসৈনিক বলেন, ‘সভ্যতা এবং তখনকার কাল বা এখনকার কাল সবমিলিয়ে আপনাকে যা দেওয়ার কথা তা দেয়নি। আপনার প্রাপ্যটা আপনাকে দেয়নি, আপনাকে শোষণ করেছে। এগুলো অনেক লম্বা কথা। বলা যায় না, বলে শেষ করা যায় না।’
আরও পড়ুন• সর্বস্তরে হোক বাংলা ভাষার প্রচলন• বাংলা ভাষার ভবিষ্যত : ভাবনা-দুর্ভাবনা
Advertisement
তিনি বলেন, ‘যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলাম সেই উদ্দেশ্য এখন একেবারেই বাস্তবায়িত হয়নি। একাদশ শ্রেণিতে বাংলায় লেখা, বাংলায় পড়া- এতে কিছু প্রমাণ হয় না। এই দুটো ক্লাস (বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি মিডিয়াম) যে আলাদা হয়ে গেলো, এটাতে ক্ষতিই হলো। ইংরেজি মিডিয়ামে যারা পড়ছে তারা উচ্চশিক্ষায় বেশি সুযোগসুবিধা পাচ্ছে, বাংলা মাধ্যমের এরা পাচ্ছে না। তাহলে বাংলা মাধ্যমের প্রচলন করে কি ভালো হয়েছে? আপনাকে স্বীকার করতে হবে যে ভালো হয়নি৷ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো’ এই স্লোগান তাহলে ভুল! ভুল ছিল!’
আহমদ রফিক বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আমরা কতটুকু সুবিধা পেলাম বা না পেলাম, রাষ্ট্রভাষা বাংলা, মাতৃভাষা বাংলা এগুলো কতটা সুবিধা আমাদের দিলো- এগুলো যদি বিচার করি তাহলে খুব একটা ভালো ফলাফল পাই না। ফলাফল পাই না এজন্য যে আমাদের কলোনিয়াল স্ট্যাটাস সব কেড়ে নিয়েছে। মীর জাফরদের মতো বিশ্বাসঘাতকরা যদি না থাকতো তাহলে অবস্থা হয়তোবা ভিন্ন হতো। আমরা ১৯০ বছর বিলাতি শাসকদের দ্বারা শোষিত হয়েছি। এসব আমাদের জীবনযাপনকে পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে দেওয়ার ফলে আমরা বলতে পারছি না যে আমরা খুব ভালো আছি। স্বাধীন হওয়ার পরে কিছু সুবিধা তো পেয়েছি, কিছু সুবিধা তো ভোগ করছি, এটা সত্য। সবকিছু মিলে আমার মনে হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটি সফল ভাষা আন্দোলন, একটি সফল আন্দোলন। সফল আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যতটুকু পাওয়ার পেয়েছি, যতটুকু দেওয়ার দিয়েছি অথবা দিতে চেষ্টা করেছি বলা ভালো। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর হয়ে গেলো। এত বছর পরে যদি হিসাব করেন আমরা দেখবো যে আমরা ভালো-মন্দ নিয়েই আছি, এটাই নিয়ম।’
আরও পড়ুন• নিশ্চিত হয়নি বাংলায় সাইনবোর্ড-নামফলক ব্যবহার, নেই তদারকি• জবিতে ভবনের নামেই সীমাবদ্ধ ভাষা শহীদ রফিকের স্মৃতি
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হওয়া সম্ভব না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সময় দেখেন ইংরেজি স্টাইলে। আপনি কলম দিয়ে যখন তারিখ লেখেন এটা খ্রিষ্টীয় তারিখ। এটা আমাদের ঘাড়ের ওপরে ভূতের মতো, জিনের মতো চেপে আছে। এটা আমাদের জন্য ভবিতব্য। এটা অনেকটা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো। ঘাড়ে নিয়ে চলতেছি, চলবো যতদিন বেঁচে আছি, চলতে হবে।’
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি অনেক সময় তারা নিজস্ব ভাষায় পড়ার জন্য আন্দোলন করে। আমরা যদি আমাদের ভাষা নিয়ে দাবি করতে পারি, আন্দোলন করতে পারি তাহলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এই দাবি আমরা অস্বীকার করবো কেমন করে? তাদের চাহিদা এবং দাবিকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। ওরা যেহেতু সংখ্যায় কম এবং তাদের ভাষা প্রচলিত না, এজন্য তাদের ভাষাকে আমরা সরিয়ে দিতে পারি না।
এনএস/ইএ/জেআইএম