ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানীর ১১টি সড়ক ভাষাসৈনিকদের নামে নামকরণ করেছিল অভিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন। কীর্তিমান সেই ভাষাসৈনিকদের সড়কের নামফলক এখন জরাজীর্ণ। কয়েকটি নামফলক ভেঙে রয়েছে। সাদা মার্বেলের ওপর লেখা ভাষাসৈনিকদের জীবনবৃত্তান্ত মুছে গেছে। তার ওপর সাঁটানো হয়েছে ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার। কিন্তু এসব নামফলক সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।
Advertisement
ভাষাসৈনিকদের নামে করা এই ১১টি সড়কের মধ্যে ১০টি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ধানমন্ডি এলাকায়। একটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মিরপুর-১ নম্বরে। যদিও প্রতি বছরের মতো এবারও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন নির্বিঘ্ন করতে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে ডিএসসিসি। কিন্তু তারা কেন ওই সড়কগুলোর নামফলক সংস্কার করছে না, তার সঠিক জবাব পাওয়া যায়নি।
ভাষাসৈনিকদের নামে করা এসব সড়ক, নামফলক, কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছে তা ডিএসসিসি এবং ডিএনসিসির অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই জানেন না। সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো আগ্রহও দেখা যায়নি। ফলে যে মহৎ উদ্দেশে ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কগুলোর নামকরণ হয়েছে তা এখন অনেকটাই ম্লান। সম্প্রতি রাজধানীর শিক্ষা চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কটি আরেক ভাষাসৈনিকদের নামে নামকরণ করেছে ডিএসসিসি
এদিকে, ভাষাসৈনিকদের নামে করা এসব সড়ক, নামফলক, কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে তা ডিএসসিসি এবং ডিএনসিসির অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই জানেন না। সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো আগ্রহও দেখা যায়নি। ফলে যে মহৎ উদ্দেশে ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কগুলোর নামকরণ করা হয়েছে তা এখন অনেকটাই ম্লান। সম্প্রতি রাজধানীর শিক্ষা চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কটি আরেক ভাষাসৈনিকের নামে নামকরণ করেছে ডিএসসিসি।
Advertisement
আরও পড়ুন>>• সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার না হওয়াই আমাদের বড় ব্যর্থতা• জাতিসংঘে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ• বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বায়নের পথে এগোতে পারেনি
ধানমন্ডি এবং মিরপুরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই সড়কগুলোর নামকরণের ১৭ বছর পরও নামফলক সংস্কার করা হয়নি। সিটি করপোরেশনের সঠিক তদারকির অভাব এবং অবহেলায় এসব নামফলক এখন জরাজীর্ণ। ফলে ভাষা আন্দোলনের বীরদের এবং তাদের বীরত্বের ইতিহাস মানুষ জানতে পারছে না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ভাষাসৈনিকদের নামে করা এসব সড়কের নামই জানে না। এছাড়া বাসাবাড়ি এবং অফিসের ঠিকানায় এসব সড়কের নাম ব্যবহার হচ্ছে না। এখন ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির এসব সড়কের নামফলক সংস্কার, সংরক্ষণ এবং ঠিকানায় ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ডিএসসিসি সচিবের দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানীর কিছু সড়ক ভাষাসৈনিকদের নামে করতে একটি উপ-কমিটি করেছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। এই উপ-কমিটির পুরো নাম ‘ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন রাস্তা, অবকাঠামো এবং স্থাপনার নামকরণ উপ-কমিটি।’
তখন এই কমিটি ধানমন্ডির ৯ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব সড়ক, ৮ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সড়ক, ৭ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সড়ক, ৬ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সড়ক, ৫ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সড়ক, ৪ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক অলি আহাদ সড়ক, ৩ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক, ১ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক, ১৫ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সড়ক, ৯/এ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক তোয়াহা সড়ক ও মিরপুর টেকনিক্যাল কলেজের মোড় থেকে মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত সড়ককে ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কালাম সড়ক হিসেবে নামকরণের প্রস্তাব দেয়।
Advertisement
পরে একই বছরের ২৫ জুলাই ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১১তম সাধারণ সভায় এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হয়ে ডিএসসিসি এবং ডিএনসিসি নামে পৃথক দুটি সংস্থা হয়। তখন ডিএনসিসির অধীনে চলে যায় প্রিন্সিপাল আবুল কালাম সড়ক। বাকি সড়কগুলো থেকে যায় ডিএসসিসির অধীনে।
সিটি করপোরেশনের সঠিক তদারকির অভাব এবং অবহেলায় এসব নামফলক এখন জরাজীর্ণ। ফলে ভাষা আন্দোলনের বীরদের এবং তাদের বীরত্বের ইতিহাস মানুষ জানতে পারছে না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ভাষাসৈনিকদের নামে করা এসব সড়কের নামই জানে না। এছাড়া বাসাবাড়ি এবং অফিসের ঠিকানায় এসব সড়কের নাম ব্যবহার হচ্ছে না। এখন ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির এসব সড়কের নামফলক সংস্কার, সংরক্ষণ এবং ঠিকানায় ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে
মাতৃভাষা দিবসের একদিন আগে মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সড়কের নামফলকে টু-লেট, রাজনৈতিক পোস্টারে ছেয়ে গেছে। ফলে এ ফলকে সড়কের নামটিও বোঝা যাচ্ছে না। ফলকের নিচের অংশের ইট-পাথর ভেঙে গেছে। রডগুলো বের হয়ে আছে। সাদা মার্বেলের ওপর ধুলাবালি জমে কালো হয়ে আছে।
অলি আহাদ সড়কে নামফলকের সামনে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী চায়ের দোকান। এ কারণে সড়ক থেকে ফলকটি দেখা যায় না। রঙিন দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো সাদা মার্বেল পাথরে লেখা ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক। কিন্তু দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি নামফলক। শেখ জামাল ক্লাবের সামনে থেকে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের দিকে যেতে সেতুতে ওঠার আগে রয়েছে আরেকটি নামফলক। কিন্তু এ ফলকের ওপর পোস্টার সাঁটানো। ফলে সড়কটি কার নামে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। শুধু নিচের অংশে লেখে সড়কটির উদ্বোধন করেছেন প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। অন্য সড়কের ফলকগুলোতেও প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে।
আরও পড়ুন>>• সাইনবোর্ড বাংলায় না লিখলে কঠোর পদক্ষেপে যাচ্ছে ডিএনসিসি• সর্বস্তরে হোক বাংলা ভাষার প্রচলন• বাংলা ভাষার ভবিষ্যত : ভাবনা-দুর্ভাবনা
ভাষাসৈনিক অলি আহাদ সড়কের (৮ নম্বর সড়ক) প্রবীণ বাসিন্দা মহিউদ্দিন খান। কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় দুই যুগ আগে ধানমন্ডির এ সড়কগুলো ভাষাসৈনিকদের নামে নামকরণ করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু আধিকাংশ মানুষই ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কগুলো চেনেন না, ঠিকানাও ব্যবহারও করেন না। সড়কে নামফলক বসানো হলেও সেগুলো প্রচার এবং ব্যবহারে কোনো ভূমিকা রাখেনি সিটি করপোরেশন। এতে ভাষাসৈনিকদের বীরত্বের ইতিহাস তেমন কেউ জানতে পারছেন না।
বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট কৃষি ও উদ্যান সংশ্লিষ্ট ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। ওই জমি সমতল করে জনগণের মধ্যে প্লট বরাদ্দ করে। পরে ডিআইটি জনসাধারণের সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি, রাস্তা ও অন্যান্য ভৌত কাঠামো নির্মাণকাজ হাতে নেয়। তখন এলাকাটি কয়েকটি ব্লকে (নম্বর) বিভক্ত করা হয়। এরপর থেকেই ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকা নম্বর হিসেবে পরিচিতি পায়। যেমন- ধানমন্ডি-১, ধানমন্ডি-৩ ইত্যাদি।
ধানমন্ডির এই সড়কগুলো ডিএসসিসির ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। জানতে চাইলে এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম বাবলা জাগো নিউজকে বলেন, ভাষাসৈনিকদের নামে করা এসব সড়ক ধানমন্ডিবাসীর জন্য গৌরবের। অনেকেই না জেনে নামফলকে পোস্টার লাগাচ্ছেন। বিষয়টি চোখে পড়েছে। বিষয়টি ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। এছাড়া ঠিকানায় যেন ভাষাসৈনিকদের নামে করা সড়কগুলো ব্যবহার করা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালাবো।
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন নির্বিঘ্ন করতে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের। কিন্তু এসব কার্যক্রমে ধানমন্ডিতে ভাষাসৈনিকদের নামে করা সড়কের নামফলকগুলো সংস্কার বা পরিষ্কারে কোনো তথ্য ছিল না।
সম্প্রতি ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের নামে রাজধানীর একটি সড়কের নামকরণ করেছে ডিএসসিসি। শিক্ষা অধিকার চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কটি ভাষাসৈনিক শফিউর রহমান নামে নামকরণ করেছে সংস্থাটি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এই সড়কের নামফলক স্থাপন করেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এখন শিক্ষা ভবন থেকে দোয়েল চত্বর বা বাংলা একাডেমিতে বইমেলায় যেতে এই নামফলক যে কারেও চোখে পড়বে
জানতে চাইলে আবু নাছের জাগো নিউজকে বলেন, ভাষাসৈনিকরা দেশের বীর সন্তান। তাদের বীরত্বের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতেই ওই সড়কগুলোর নাম ভাষাসৈনিকদের নামে করা হয়েছে। এসব সড়কের নামফলক গত বছরও সংস্কার করা হয়েছে। এবার সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ওপরে পোস্টার লাগানোর কোনো তথ্য পাইনি। আমরা খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কালাম সড়ক: ডিএনসিসির মিরপুর টেকনিক্যাল কলেজ মোড় থেকে মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কালাম সড়কে মাত্র একটি নামফলক রয়েছে। এই ফলকের ওপরও বিভিন্ন পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। ফলে সড়কের নামটি তেমন কারও চোখে পড়ে না। এছাড়া এ এলাকার কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া ওই সড়কের নাম ঠিকানায় ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন>> • নামফলক-সাইনবোর্ডে দেখা মিলছে বাংলা• প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলা করার দাবি• সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কি দুরাশা?
এ সড়কের নামকরণ এবং নামফলক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ তদারকি করে ডিএনসিসির নগর পরিকল্পনা বিভাগ। এই বিভাগের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেমের মোবাইল ফোন সংযোগ বন্ধ থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষা ভবন থেকে দোয়েল চত্বর রাস্তাটি এখন ভাষাশহীদ শফিউর রহমান সড়ক: সম্প্রতি ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের নামে রাজধানীর একটি সড়কের নামকরণ করে ডিএসসিসি। শিক্ষা অধিকার চত্বর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কটি ভাষাসৈনিক শফিউর রহমানের নামে নামকরণ করেছে সংস্থাটি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এই সড়কের নামফলক স্থাপন করেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এখন শিক্ষা ভবন থেকে দোয়েল চত্বর বা বাংলা একাডেমিতে বইমেলায় যেতে এ নামফলক যে কারও চোখে পড়বে।
এমএমএ/এমকেআর/এএসএম