অর্থনীতি

‘জেড’ গ্রুপ নিয়ে ‘ভুতুড়ে’ সিদ্ধান্ত, ক্ষতির মধ্যে বিনিয়োগকারীরা

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনায় পরবর্তী লভ্যাংশ ঘোষণার পর ‘জেড’ প্রুপে নেওয়ার কথা বলা হলেও হুট করে আজ রোববার থেকেই ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন এ প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা।

Advertisement

কিসের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেড গ্রুপে যাবে, সে বিষয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। ওই নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে বলা হয়, ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনায় এমন বলা হলেও রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জেড গ্রুপ নিয়ে দেওয়া নির্দেশনা এবং হুট করে বাস্তবায়ন করার বিষয়টিকে ‘ভুতুড়ে’ বলছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ।

তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে এক রকম, আর বাস্তবায়ন হয়েছে অন্যভাবে। বিএসইসির নির্দেশনায় যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে কোম্পানিগুলোর পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা আসার পর জেড গ্রুপে স্থানান্তর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু লভ্যাংশ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই হুট করে ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

Advertisement

তারা আরও বলছেন, কার স্বার্থে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তা খতিয়ে দেখা উচিত। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে সার্বিক বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয়হীতার চিত্রও ফুটে উঠছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে এক রকম, আর বাস্তবায়ন হয়েছে অন্যভাবে। বিএসইসির নির্দেশনায় যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে কোম্পানিগুলোর পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা আসার পর জেড গ্রুপে স্থানান্তর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু লভ্যাংশ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই হুট করে ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন>> ৫ দিনে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের দাম কমলো ৬১ কোটি টাকা

অন্যদিকে বিএসইসি’র পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সার্বিক বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে জেড গ্রুপ নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ। সুতরাং স্টক এক্সচেঞ্জ থেকেই এ বিষয়ে প্রকৃত ব্যাখা দিতে পারবে।

Advertisement

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনার আলোকেই ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিএসই’র প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিআরও) এ বিষয়ে বিএসইসি’র সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।

জেড গ্রুপ নিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জারি করা বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়, যেসব কোম্পানি পরপর দুই বছর লভ্যাংশ দেবে না এবং দুই বছর বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করবে না সেগুলো জেড গ্রুপভুক্ত হবে। এছাড়া ছয় মাস কোনো কোম্পানি উৎপাদনে না থাকলেও জেড গ্রুপভুক্ত হবে। এমনকি কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস পরিশোধিত মূলধনের থেকে বেশি হলেও, ওই কোম্পানির ঠিকানা হবে জেড গ্রুপে।

তবে নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এই নির্দেশনা কার্যকর হবে।

আরও পড়ুন>> বাজার মূলধন হারালো ৬ হাজার কোটি টাকা

কিন্তু বিএসইসির নির্দেশনা জারির পর রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) থেকেই হুট করে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আরামিট সিমেন্টস, আজিজ পাইপস, ডেল্টা স্পিনিং, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, জিবিবি পাওয়ার, ইনটেক, ইন্টারন্যাশনল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, কেয়া কসমেটিকস, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ন্যাশনাল টি, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্স, রিজেন্ট টেক্সটাইল, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, রিং শাইন টেক্সটাইল, সাফকো স্পিনিং, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, ঢাকা ডাইং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইয়াকিন পলিমার এবং জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজকে জেড গ্রুপভুক্ত করেছে ডিএসই।

জেড গ্রুপভুক্ত হওয়ায় এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ সুবিধাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত আসায় রোববার লেনদেনের শুরুতেই বড় ধরনের দরপতনের মধ্যে পড়ে কোম্পানিগুলো। এমনকি লেনদেন শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কয়েকটির ক্রেতা উধাও হয়ে যায়। দিনের লেনদেন শেষে ১২ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে হল্টেড হয়েছে।

লেনদেনের প্রায় পুরো সময়জুড়ে কোম্পানিগুলোর ক্রয়াদেশের ঘর শূন্য পড়ে থাকে। বিপরীতে দিনের সর্বনিম্ন দামে কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ শেয়ারের বিক্রয় আদেশ আসে। ফলে লোকসানে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন অনেক বিনিয়োগকারী।

আব্দুর রাজ্জাক নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, হুট করে ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরমধ্যে দুটি কোম্পানিতে আমার বিনিয়োগ রয়েছে। দুই কোম্পানির শেয়ারের দাম একদিনে যতটা কমা সম্ভব ততটাই কমেছে। এতে আমি বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছি। লোকসান দিয়েই আজ দিনের সর্বনিম্ন দামে কোম্পানি দুটির শেয়ার বিক্রি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। জানি না আর কত লোকসান হবে।

ইব্রাহিম হোসেন নামের আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, ২২ কোম্পানি জেড গ্রুপ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থবিরোধী হয়ে গেছে। যাদের কাছেই এ ২২ কোম্পানির শেয়ার আছে, তারা বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছেন। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর বাজার যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাজারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

আমাদের সিআরও বিএসইসি সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে এটা ঠিক করেছেন। বিএসইসি যেভাবে বলেছে, সেভাবেই করা হয়েছে- ডিএসই এমডি ড. এটিএম তারিকুজ্জামান

ডিএসই’র এক সদস্য বলেন, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে দীর্ঘদিন বাজার এক প্রকার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর বাজারে যখন গতি ফিরছিল, তখন জেড গ্রুপ নিয়ে নির্দেশনা আবার নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এমনকি জেড গ্রুপ নিয়ে একই দিনে বিএসইসি দুটি নির্দেশনা জারি করেছে। এতে বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কমিশন সময়ে সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তারই আলোকে জেড গ্রুপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিএসইসির নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে বলা হয়েছে- ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এই নির্দেশনা কার্যকর হবে। তাহলে রোববার থেকে কেন ২২ কোম্পানি জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হলো? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কীভাবে কী করতে হবে তা কমিশনের নির্দেশনায় বলে দেওয়া হয়েছে। আর এটি বাস্তবায়ন করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ। রোববার থেকে ২২ কোম্পানি জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়ার সঠিক ব্যাখা স্টক এক্সচেঞ্জ দিতে পারবে।

এ নিয়ে জানতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. এটিএম তারিকুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বিএসইসির নির্দেশনা মেনেই ২২ কোম্পানি জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে- ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে নির্দেশনা কার্যকর হবে। এমন পাল্টা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমাদের সিআরও বিএসইসি সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে এটা ঠিক করেছেন। বিএসইসি যেভাবে বলেছে, সেভাবেই করা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বিএসইসির নির্দেশনায় কী বলা হয়েছে, সেটি আমি দেখিনি। নির্দেশনাটি পুরোপুরি না দেখে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে আমি মনে করি নির্দেশনায় যেভাবে বলা হয়েছে, বাস্তবায়ন সেভাবেই হওয়া উচিত।

এমএএস/এমএইচআর/জেআইএম