ফরিদপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ নীলটুলি স্বর্ণকার পট্টিতে দিনরাত অনিয়ন্ত্রিতভাবে পোড়ানো হচ্ছে নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিড। এর ফলে বিষাক্ত ধোঁয়ায় স্থানীয় অধিবাসীদের শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকলেও দেখার যেনো কেউ নেই।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা যায়, বাণিজ্যিক এলাকার সঙ্গে শহরের গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকাও এখানে। রয়েছে অনেকগুলো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল। শহরের প্রধান রাস্তা মুজিব সড়কের সবচেয়ে ব্যস্ততম অংশ এখানেই। তবে অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে জনসাধারণের সড়কে চলাচল করাই দায়। শুধু শহরেই নয়, উপজেলাগুলোর প্রতিটি বাজারেই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
সন্ধ্যা নাগাদ বাতাসে এই অ্যাসিডের মাত্রা ভয়াবহ আকারে পৌছে। তখন চলাচলরত মানুষ বিশেষত নারী ও শিশুদের অনেকে নাক-মুখ ঢেকে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
ফরিদপুরে নীলটুলি স্বর্ণকার পট্টিতে শতাধিক জুয়েলারি দোকান ছাড়াও শহরের বিভিন্নস্থানে গড়ে ওঠা স্বর্ণকারের দোকানে অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিড। অ্যাসিড পোড়ানোর নীতিমালা থাকলেও তা কেউ মানছেন না।
Advertisement
নীলটুলি স্বর্ণকারপট্টি সহ বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা যায়, অ্যাসিড পোড়ানোর জন্য আলাদা কক্ষ ও চিমনি ব্যবহার করার বিধান থাকলেও অধিকাংশ দোকানেই সেটি নেই। এসব স্বর্ণের দোকানের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমতি নেই। ওই এলাকায় অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে সকাল থেকে রাত অব্দি কয়েক হাজার কর্মচারী ও দোকান মালিক অবস্থান করেন। তারাও এ দূষণের শিকার। এসিড পোড়ানোর কারণে তাদের শ্বাস কষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোনার গহনা তৈরির জন্য অ্যাসিড ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। সোনা থেকে খাদ বের করার জন্য নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে পোড়াতে হয়। আর গহনার সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহার করা হয় সালফিউরিক অ্যাসিড। ব্যবহারের সময় এ অ্যাসিড বাতাসে মিশে বিষাক্ত জ্বলীয়বাষ্পে রূপ নেয় এবং তা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। এজন্য আইন অনুযায়ী স্বর্ণের দোকান গুলোতে ২০ ফুট উচু চিমনি ও সোনার অলঙ্কার তৈরির নিজস্ব কারখানা থাকতে হবে। কিন্তু সরকারি নিয়মনীতির প্রতি তোয়াক্কা নেই স্বর্ণকারের দোকানগুলোতে।
২০০৪ সালের ‘এসিড নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’ নামক গেজেটের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিনা লাইসেন্সে কোনো ধরনের অ্যাসিড ব্যবহার করতে পারবে না কেউ। এ বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর দেখভাল করে থাকে বলে জানা যায়।
শহরের ঝিলটুলীর বাসিন্দা অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমেদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, স্বর্ণকারপট্টির এ সড়কে যাতায়াতের সময় ধোঁয়ার কারণে আমার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়।
Advertisement
ওই এলাকার বাসিন্দা কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, বারবার বলা সত্ত্বেও কোনো লাভ হচ্ছে না। অ্যাসিডের ধোঁয়া পথচারী, বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন অফিসের লোকজনের স্বাস্থ্যহানী এবং পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসকেরা জানান, এর প্রভাবে মানুষের শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ছাড়াও হার্টের সমস্যা হতে পারে। নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডযুক্ত ভারী গ্যাস সালফিউরিক অ্যাসিড বাতাসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, হৃদরোগসহ নানা উপসর্গের জন্ম দেয়।
এ অ্যাসিডে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্বীকার করে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, তিনবার নাইট্রিক অ্যাসিড আর একবার সালফিউরিক অ্যাসিড না মেলালে স্বর্ণের কোনো কাজ তারা করতে পারেনা। তবে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা কতটুকু সেটি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও শরৎ জুয়েলার্সের মালিক শ্যামল কর্মকার জাগো নিউজকে বলেন,প্রকাশ্যে এসিডের ব্যাবহার করার নিয়ম নেই। তারপরও আমাদের পক্ষ থেকে এসিড ব্যাবহারকারীদের নিয়মনীতি অনুসরণ করে ব্যাবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি ও প্রগতি জুয়েলার্সের মালিক নন্দ বড়াল জাগো নিউজকে বলেন, ফরিদপুর শহরে প্রায় শতাধিক স্বর্ণের দোকান রয়েছে। এরমধ্যে শো-রুমগুলোতে এসিডের ব্যাবহার করা হয় না।কারখানাগুলোতে এসিডের ব্যাবহার করা হয়। শহরে এ ধরনের পাঁচটি কারখানা রয়েছে তার মধ্যে তিনটি কারখানার এসিড ব্যাবহারের লাইসেন্স আছে,নতুন করে দুটির জন্য আবেদন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর ফরিদপুরের উপপরিচালক মো. সাঈদ আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি তেমনভাবে জানা নেই। কেউ অভিযোগও করেনি। তবে যেহেতু আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়মের আওতায় আনার জন্য সতর্ক করা হবে।
এন কে বি নয়ন/এনআইবি/জেআইএম