ব্যাংক খাতের দুটি বেশ বড় খবর এলো সম্প্রতি। পরিচালকদের চাপ ও ব্যাংকের ভিতরে সামগ্রিক কর্ম সংস্কৃতি অস্বস্তিকর পরিবেশ সইতে না পেরে ব্যাংক ছেড়ে চলে গেছে। ঘটনা ঘটেছে এনআরবি ব্যাংকে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ শাহ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'আমি ব্যাংকে অস্বস্তি বোধ করছিলাম, তাই পদত্যাগ করেছি।'
Advertisement
প্রবাসী ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবি ব্যাংকে সমস্যা চলছে আরও অনেক ব্যাংকের মতোই। এর আগে গত বছর চার ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছিলেন। তাদের মধ্যে উদ্যোগী হয়ে তিনজন এমডিকে নিজ পদে ফিরিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কয়েকটি পত্রিকায় যে খবর বের হয় তাতে দেখা যায় ব্যাংকটি পেশাদারত্বের সাথে চলছে না।
অভিযোগ আছে, কয়েকজন পরিচালকের চাপে ব্যাংকটিতে গত কয়েক মাসে বেশ কিছু ঋণ অনুমোদন হয়, যা নিয়মিতভাবে আদায় হচ্ছে না। সম্প্রতি আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই বেনামি ঋণ। এই বেনামি ঋণের জের ধরেই এমডি পদ ছেড়ে দিয়ে বেঁচেছেন।
সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, এনআরবি ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অ্যালায়েন্স হাসপাতালের নামে ৫৫ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণের অনুমোদন হয়। হাসপাতালটি ভাড়া ভবন থেকে পরিচালিত হয়, ঋণের বিপরীতে তেমন কোনো জামানতও নেই।
Advertisement
ঋণটির আদায় ইতিমধ্যে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। একইভাবে গত বছরের আগস্টে নতুন নিবন্ধিত হওয়া বরুণ করপোরেশনের ১৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়। এই ঋণও নিয়মিতভাবে ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। গত আগস্টে বেলা অ্যাগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় চার কোটি টাকা। এই ঋণ ইতিমধ্যে অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।
ঠিক এরকম যখন অবস্থা, মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় যখন এমডিকে পদ ছাড়তে হয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালকদের (বাংলাদেশে মালিক শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়) জন্য নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা জারি করে ব্যাংক পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণের সম্মানী বাড়িয়েছে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালকদের জন্য প্রথমবারের মতো স্থায়ী সম্মানী চালু করা হয়েছে।
এখন থেকে পরিচালকরা প্রতি সভায় অংশগ্রহণের জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা সম্মানী পাবেন, আগে যা ছিল ৮ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে এ সম্মানী ৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এদিকে স্বতন্ত্র পরিচালকদের এখন থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা স্থায়ী সম্মানী দিতে হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে স্বতন্ত্র পরিচালকরা কোনো স্থায়ী সম্মানী পেতেন না।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নৈরাজ্য চলছে। তবে এটি দেশবাসীর কাছে নতুন কোনো খবর নয়। সবাই জানে। জনগণ ব্যাংকে টাকা রাখে, ব্যাংক সেই টাকা লগ্নি করে সঞ্চয়ীদের মুনাফা দেয়। ব্যাংক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকারদের মাধ্যমে। পরিচালকরা বোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমে নীতি পরামর্শ দেবেন। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে তাদের অবস্থান নক্ষত্র সমান দূরে থাকার কথা। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না।
Advertisement
এখন জনগণের টাকা পরিচালন করা ব্যাংকগুলোতে মালিকদের একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং সেটা আইন করেই কায়েম করা হয়েছে। এ ব্যক্তিরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। চাঁদাবাজ, অসৎ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে ব্যাংক মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায়। মালিকদের এমন সুবিধা দেওয়া হয়েছে সরকারের উদ্যোগেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবারও ব্যাংকের মালিকদের আবদার পূরণ করলো সরকার। ব্যাংকে পরিচালক পদে টানা ১২ বছর থাকার সুযোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।
সংসদে উপস্থাপিত বিলে ৯ বছরের প্রস্তাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১২ বছর নির্ধারণ করে আইনটি পাস হলো। কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি দেখানো যাবে না– এমন সুযোগও রাখা হয়েছে। তাদের ঋণ পেতেও কোনো সমস্যা হবে না।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালক পদে ছয় বছরের পরিবর্তে টানা ৯ বছর এবং এক পরিবার থেকে দুজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এবার তাদের জন্য সুযোগ আরও বাড়ানো হলো। এবারের সংশোধনীতে ১২ বছর মেয়াদ কার্যকর হচ্ছে ২০১৮ সাল থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কোনো শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিখাতের ব্যাংক মালিকরাই পুরো আর্থিক খাত পরিচালনা করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার ফলে হলমার্ক কেলেংকারি হয়েছে, বেসরকারি খাতে মালিকদের খবরদারি আর দুর্নীতিতে বেসিক ব্যাংক শেষ হয়েছে, ফার্মার্স ব্যাংক উধাও হয়ে পদ্মা ব্যাংক নাম নিয়েও ডুবতে বাকি আছে, পি কে হালদারের মতো ডাকাত হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে, শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর মতো ব্যাংকখোর নিরাপদে দেশ থেকে চলে যেতে পেরেছে, শক্তিশালী ব্যাংক ইসলামি ব্যাংক ধুকছে। একক ব্যক্তির হাতে অনেকগুলো ব্যাংক অর্থনীতিতে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
আরেকটি দৃশ্যমান কারণ হলো দ্বৈত শাসন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো আর্থিক খাতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য সৃষ্টি করায় বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত ক্ষমতাহীন এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন আর আসবেই না, এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ঋণ খেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া, মালিকদের পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী করাসহ সব আয়োজন বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী করায়ত্ত করেছে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/ফারুক/এমএস